একনাগাড়ে এক বছর দু মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ থাকায় স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের মাঝে নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব কাজ করছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, দীর্ঘদিন মুখোমুখি ক্লাসের বাইরে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি (লার্নিং গ্যাপ) তৈরি হয়েছে বলে শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বিগত বছরের অনেক আবশ্যকীয় শিখন দক্ষতা অর্জন না করেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে গেছে। এই শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নিতে না পারলে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই এই ঘাটতি দূর করার জন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। এই পরিকল্পনার মধ্যে পূর্ববর্তী শ্রেণিসহ বর্তমান শ্রেণির শিখন দক্ষতা অর্জনের নির্দেশনা থাকতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু শেখার সাথে সাথে আগে শেখার কথা থাকলেও শিখতে পারেনি এমন বিষয়গুলোও আস্তে আস্তে শিখতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সাথে মানসিক দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদৌ খোলা সম্ভব কিনা তা পুন:বিবেচনার প্রয়োজন হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। এমতাবস্থায় বিকল্প পন্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ চালু রাখা বা পাঠদান অব্যাহত রাখার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া বাঞ্ছনীয় বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা প্রতিরোধী টিকা প্রদানের জন্যও সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে টিকা প্রদান সম্পন্ন করতে পারলে করোনার ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করেছেন তাঁরা।
অনুমান করা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেক বড় অংশ হয়তো আর ক্লাসে ফিরবে না। শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে, বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনেক পরিবারের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে ঐসব পরিবারের শিশুরা স্কুলে নাও ফিরতে পারে। এমন সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফেরানোর জন্য বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বিভিন্নভাবে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য কী কী করা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা দরকার। প্রফেসর ড. মো. শাহাদৎ হোসেন খান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, আমরা ইতোমধ্যে এক বছরের বেশী সময় অতিক্রম করেছি আমাদের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো কার্যকরী বিকল্প ভাবনা ছাড়াই, যার মাসুল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে। আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। এ মহামারীর মধ্যেও আমাদের বিকল্প পন্থা তৈরি করতে হবে, যাতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে না যায়। সার্বিক দিক বিবেচনায় সুনির্দিষ্ট কতিপয় প্রস্তাবনা রাখতে চাচ্ছি যা আমাদের নীতিনির্ধারণী মহলকে একটি ইঙ্গিত দিতে পারে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্ব-উদ্যোগে ধাপে ধাপে কিছু সেমিস্টার সমাপনী পরীক্ষার আয়োজনও সম্পন্ন করেছে। এটিকে একটি সম্ভাব্য বিকল্প বিবেচনায় নিয়ে এটি অব্যাহত রাখাই সমীচীন। ক্লাস সমূহ অনলাইনে নেয়ার যে প্রক্রিয়া চলমান আছে তা আরো সমৃদ্ধ ও জোরদার করতে হবে। সকল ব্যাচের একসঙ্গে পরীক্ষা না নিয়ে গুরুত্বানুযায়ী বিভিন্ন ব্যাচের পরীক্ষা আলাদা আলাদা সময়ে চলমান রাখা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে সকল বিষয়ে অনলাইন ক্লাস কোন ইতিবাচক সমাধান নয়।
সেক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে বা কোন বিশেষ ব্যাচের জন্য সাময়িক সময়ের জন্য হল সমূহ খুলে দিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ বন্ধ রাখার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রচলিত হল ভিত্তিক আবাসন ব্যবস্থা যেখানে করোনা স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালক করা প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ব্যাচের পরীক্ষা শেষ হলে তাদেরকে হল ছেড়ে দিতে হবে পরবর্তী অন্যকোনো ব্যাচের ক্লাস পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য। যথাযথ কর্ম পরিকল্পনাই আমাদের করোনা মহামারী কালীন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক সংকট কাটিয়ে ওঠার উপায়ও খুঁজতে হবে।