ভূমিকম্পের কথা কি আগে জানা যাবে?

| সোমবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে সম্প্রতি ৬.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি ও স্থাপনা। এর কয়েক মাস আগেই তুরস্কের দক্ষিণপূর্বে এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আঘাত করা দুটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। অনেক মানুষ আহত বা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ এসব ভূমিকম্প আঘাত করে।

প্রশ্ন হলো, কেন আমরা এটা আগে থেকে বুঝতে পারিনি? বাস্তবতা হলো, বৈজ্ঞানিকভাবে আগে থেকেই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া কঠিন। যদিও একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রায়ই ভূকম্পনজনিত ডেটা বা তথ্যে মিনিটের সংকেত শনাক্ত করা যায়, তবে কী অনুসন্ধান করতে হবে সেটা বোঝা এবং পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। খবর বিবিসি বাংলার।

ইতালির রোমের সেপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানের এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস ম্যারোন বলেন, যখন আমরা পরীক্ষাগারে ভূমিকম্পের পরীক্ষা চালাই তখন আমরা এই সমস্ত ব্যর্থতা দেখি, যেখানে প্রথমে কিছু ফাটল এবং কিছু ত্রুটি দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতিতে অনেক অনিশ্চয়তা থাকায় আমরা প্রায়শই বড় ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে এমন কোনো ইঙ্গিত পাই না।

১৯৬০ সাল থেকে ভূতত্ত্ববিদরা ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পাওয়ার জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করে গেলেও তাতে সফলতা পেয়েছেন সামান্য। ক্রিস ম্যারোন বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর কারণ হলো বিশ্বের বিভিন্ন দিক দিয়ে যাওয়া চ্যুতিগুলোর জটিলতা।

এছাড়া পৃথিবীর অভ্যন্তরে অনবরত সংঘর্ষের কারণে প্রচুর পরিমাণে আওয়াজ হয় এবং এটি বেশ গর্জন করতে থাকে। এগুলো আবার রাস্তার ট্রাফিক, নির্মাণকাজ এবং দৈনন্দিন জীবনের কোলাহলের সাথে মিশে যাওয়ায় সেখান থেকে ভূমিকম্পের স্পষ্ট সংকেত বাছাই করা কঠিন হয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে, একটি সত্যিকারের ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় জরুরি : এটি কোথায় ঘটবে, কখন ঘটবে এবং কত বড় আকারের হবে। সংস্থাটি বলছে, এখন পর্যন্ত কেউই নিশ্চিতভাবে এটি করতে পারে না। তার বদলে ভূতত্ত্ববিদরা তাদের সেরা অনুমান দিয়ে ‘প্রাকৃতিক বিপদ’ মানচিত্র তৈরি করে, যেখানে তারা কয়েক বছরের সময়সীমার মধ্যে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা হিসাব করে। এগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় তোলা দালানের মান উন্নত করার মতো পরিকল্পনায় কিছুটা সাহায্য করতে পারলেও জনসাধারণকে সরিয়ে নেওয়া বা নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার মতো প্রাথমিক সতর্কতা নিতে প্রয়োজনীয় পূর্বাভাস দেয় না। এছাড়া ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে থাকা সব বাসিন্দার প্রচুর পরিমাণে কম্পন সহ্য করতে পারা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের সামর্থ্যও নেই।

ম্যারোন বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এমন অনেক বিষয় ছিল যার ফলে ভবনগুলো একরকম ভেঙে পড়ার অবস্থায় ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের ভূকম্পন কোড রয়েছে, যা ১৯৭০ এবং ৮০’র দশকে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু সেভাবে ভবন তৈরি করতে কিংবা পুরনো ভবনে নতুন পদ্ধতি যুক্ত করতে অনেক খরচ হয়। তাই এর পরিবর্তে বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস আরও সঠিক করার উপায় অনুসন্ধান করছেন। ভূকম্পনের সতর্কতার পাশাপাশি প্রাণীদের আচরণ থেকে শুরু করে পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডলে বৈদ্যুতিক বিশৃঙ্খলা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় গবেষকরা এ সংক্রান্ত সূত্র খুঁজছেন।

তবে সম্প্রতি মানুষ যে সূক্ষ্ম সংকেত ধরতে পারে না তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শনাক্তের বিষয়ে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম বা গাণিতিক পরিভাষাগুলো অতীতের ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট তথ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন নমুনা অনুসন্ধান করে, যা ভবিষ্যতে এসব ঘটনার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ম্যারোন বলেন, এই ধরনের মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের পূর্বাভাস অনেক আগ্রহ তৈরি করেছে। তিনি ও তার সহকর্মীরা গত ৫ বছর ধরে এমন গাণিতিক পরিভাষা তৈরি করছেন, যা পরীক্ষাগারে কৃত্রিম ভূমিকম্পের ত্রুটি শনাক্তে সক্ষম। মুষ্টি আকারের গ্রানাইটের টুকরা ব্যবহার করে তারা পুনরায় চাপ ও ঘর্ষণ তৈরি করেন, যা একটি চ্যুতিতে ঘটতে পারে। ফল্ট বা চ্যুতি ফসকে না যাওয়া পর্যন্ত এই চাপ তৈরি করা হয়, যাকে তারা বলেন ল্যাবকোয়েক্স। স্থিতিস্থাপক তরঙ্গগুলো চ্যুতির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে, যাতে এটি ধীরে ধীরে ভেঙে যায়।

তিনি বলেন, স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্যের এই পরিবর্তন এবং চ্যুতি অঞ্চলে ফোরশক বা মৃদু কম্পন থেকে আসা শব্দের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষাগারে কখন চ্যুতি ঘটবে তা আমরা আগেই বলতে পারি। এটিকে আমরা পৃথিবীতেও প্রয়োগ করতে চাই। তবে এখন পর্যন্ত সেই সক্ষমতা হয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই আগাম পূর্বাভাসের শক্তিকে বাস্তববিশ্বের চ্যুতি অঞ্চলের বৃহত্তর এবং জটিল পরিবেশে স্থানান্তর করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। কিছু ক্ষেত্রে মানুষ ভূমিকম্পের পর কীভাবে পরবর্তী পূর্বাভাস দেওয়া যায় তা খুঁজে বের করেছে। ধারণা করা হয়, এটি কাজ করতে পারে। কিন্তু এখনও এতে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ইসরায়েলভিত্তিক আরেকটি দল সম্প্রতি দাবি করেছে, মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে তারা গত ২০ বছরের আয়নমন্ডলে ইলেকট্রনের পরিবর্তন পরীক্ষা করে ৮৩ শতাংশ নির্ভুলতার সাথে ৪৮ ঘণ্টা আগে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছে। চীন আয়নমন্ডলের এই সূত্রে আশা রাখছে।

অন্যান্য গবেষকরা বিভিন্ন সংকেতের ওপর ভরসা করছেন। জাপানে কেউ কেউ পূর্বাভাসের জন্য ভূমিকম্প অঞ্চলের উপরে জলীয় বাষ্পের পরিবর্তন সম্ভব বলে দাবি করেন। পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে, এই পূর্বাভাসের ৭০ শতাংশ নির্ভুল, যদিও তারা কেবল বলতে পারেন যে পরের মাসে যে কোনো সময়ে ভূমিকম্প হতে পারে। অন্যরা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে মিনিটের তরঙ্গ যা ভূমিকম্পের আগে ঘটে থাকতে পারে, সেটি ব্যবহারের চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব দাবি সত্ত্বেও ভূমিকম্প হওয়ার আগে কোথায় এবং কখন হবে তা কেউই সফলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধানক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে গৃহবধূর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপন