বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি উদ্ভাবন জরুরি

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা

মুহাম্মদ মুসা খান | মঙ্গলবার , ৮ জুন, ২০২১ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

করোনা সংকটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সম্পর্কে সকলেই অবগত রয়েছি। এবারের করোনা মহামারী এতই মারাত্মক যে, সমগ্র পৃথিবীর ১৯০টি দেশের ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরের ৮ মার্চ করোনা শনাক্তের পর ১৭ মার্চ হতে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে । বলা যায় সেই থেকে -দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি লণ্ডভণ্ড অবস্থায় রয়েছে। সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে আগামী ১২ জুন’২১ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ‘সব কিছু ঠিক থাকলে’ কিছু বিধিনিষেধের মধ্যে ১৩ জুন হতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে(অন্যথায় হয়তো আবারও বন্ধের ঘোষণা দিতে হবে)। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ খোলার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মঞ্জুরি কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খুব দ্রুতই শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার পরিকল্পনার কথাও আমাদের জানানো হয়েছে। এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থীদের দাবি জোরালো হচ্ছে। অবশ্য একটি অংশ শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে’ বা ‘টিকা না দিয়ে’ খোলার বিপক্ষে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
আমরাও লক্ষ্য করেছি যে, দেশের করোনা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি হয়নি। অথবা সামান্য উন্নতি হলেও আবার অবনতি হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়েও সবাই শংকিত। এরমধ্যে আবির্ভাব হয়েছে ব্ল্যাকফাংগাস নামক আরেক ভয়ংকর ব্যাধির। আবার দেশের টিকা সংকটও কাটেনি। চল্লিশোর্ধ সব নাগরিককে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা থাকলেও সংকটের কারণে সেটাও বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে- যা বলাবাহুল্য। এসব কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ও সিদ্ধান্তহীনতাই ভুগছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও আমরা জেনেছি যে, করোনা সংকট শুরু হওয়ার ৬ মাস পর হতে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছিল। আবার পরিস্থিতির অবনতি হলে তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধও করে দিয়েছে। তাই সেসব দেশের ক্ষতি অনেক কম ছিল।
প্রশ্ন হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে এভাবে ‘সিদ্ধান্তহীন অবস্থায়’ আর কতদিন থাকবো ! এভাবে মাসের পর মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের ধারাবাহিতা নষ্ট হবে, জীবনযাত্রায় নেতিবাচক পরিবর্তন আসবে, ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি থেকে তা নেশায় পরিণত হবে (যেকোন নেশাই ধ্বংসাত্মক), উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বো, শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পাবে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে আলসেমি ভাব আসবে (যেহেতু বেতন যথাসময়ে পেয়ে যাচ্ছেন), বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অর্থ সংকটে পড়বেন, বন্ধ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে (এমনকি আর্থিক সংকটে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা দেশের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে)। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, করোনা পরবর্তী সময়ে এককোটি শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবে না( যা অত্যন্ত ভয়াবহ হবে)। এসব সমস্যা সমূহ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে খুব দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ‘বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করা প্রয়োজন বলে শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন।
‘বিকল্প পাঠদান’ বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য বিগত শতকে পৃথিবীতে মহামারী আক্রমণের বিভিন্ন সময়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, সময়ে সময়ে মহামারী সংকটে পৃথিবীর অর্থনীতির পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থাও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কিন্তু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কখনো বসে থাকেনি। তাঁরা প্রয়োজনের তাগিদে ‘বিকল্প পাঠদান’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। যেমন- বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যক্ষ্মায় ইউরোপ আর আমেরিকায় মারা যেতো প্রতি সাতজনে একজন। এ তথ্য আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, সিডিসির। যক্ষ্মার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয় ১৯২১ সালে। সেই প্রতিষেধক বিশ্বের সব দেশের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে যায় আরও বেশ কিছু বছর। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চারা যাতে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে তার সমাধান হিসাবে জন্ম নেয় “খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থা”। হালকা ওজনের টেবিল ও চেয়ার মাঠে-বাগানে নিয়ে যাওয়া হতো। টিচাররা মাঠে বসে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে শুরু করেন। এই আইডিয়া (ওপেন এয়ার স্কুল) প্রথমে চালু হয় ১৯০৪ সালে জার্মানি আর বেলজিয়ামে। অল্পদিনের মধ্যেই এটা একটা আন্দোলন হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশে। উন্মুক্ত স্থানে শিক্ষাদান বিষয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে ‘লিগ ফর ওপেন এয়ার এডুকেশন’ নামে। ১৯২২ সালে এই গোষ্ঠী প্যারিসে তাদের প্রথম অধিবেশন ডাকে। আমেরিকায় খোলা মাঠে শিক্ষাদান শুরু হয় ১৯০৭ সালে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সে বছর রোড আইল্যান্ডের দুজন ডাক্তার প্রস্তাব দেন ‘শহরের খোলা জায়গাগুলোতে স্কুল বসাতে’। পরের দুবছরে এরকম ৬৫টি স্কুল খোলা হয়, খোলা চত্বরে, উঁচু ভবনের ছাদে এবং এমনকি পরিত্যক্ত নৌকায়। জার্মানি ও বেলজিয়ামের মত ব্রাজিলেও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক গঠনের জন্য তৈরি হয় ‘খোলা মাঠে পাঠদান’ শিক্ষা পদ্ধতি, যা বেশ জনপ্রিয় ছিল।
তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে এই ‘খোলা মাঠে শিক্ষাদান পদ্ধতি’ চালু না হলেও, চালু হয়েছে ‘অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি’। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা পৃথিবীর সব দেশে সমান না হওয়ায় ‘অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি’ সব দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারেনি। উন্নত দেশ গুলোতে ১০০ ভাগ শিক্ষার্থীকে অনলাইন পদ্ধতিতে আনা গেলেও, আমাদের দেশের পর্যাপ্ত প্রযুক্তি সুবিধা না থাকায় ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থীই ‘অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির’ সুফল হতে বঞ্চিত হয়েছে। যাদের অধিকাংশই মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। অন্যদিকে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ‘অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে’ কাজে লাগিয়ে, শিক্ষা সংকট ‘সম্পূর্ণ পূরণ’ করতে সক্ষম হয়েছে। অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি কাজে লাগাতে না পারার কারণে আমাদের এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আটকা পড়েছে। যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরিকল্পনা করেছিলো, তারাও পিছিয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ইউরোপ-আমেরিকার এবছরের ‘ফল সেমিস্টার’ ধরতে পারেনি। অনেকে মাস্টার্স শেষবর্ষে থেকেও ফাইনাল পরীক্ষা দিতে না পারার কারণে কর্মজীবন শুরু করতে পারেনি। ফলে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
এখন আমাদের সময় হয়েছে, করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত উত্তরণ ঘটানোর জন্য। এর জন্য প্রয়োজনে অভিজ্ঞ নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তাঁদের মতামত নিয়ে ‘বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করা যাবে। এই পদ্ধতি হতে পারে ‘অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি জোরদার করা বিষয়ক’, হতে পারে ‘খোলা মাঠে পাঠদান’, হতে পারে ‘বিকল্প দিনে শ্রেণি ভিত্তিক পাঠদান’ (যেমন-প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে শনিবার, দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস হবে রবিবার, তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস হবে সোমবার, এভাবে পরবর্তি দিনে অন্যান্য শ্রেণির ক্লাস নেয়া হবে)। এই ‘বিকল্প দিনে পাঠদান পদ্ধতি’ হাইস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা সব প্রতিষ্ঠানেই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা খোলামেলা ও কোলাহল মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। যাতে ঝুঁকিও কমে যাবে। বলাবাহুল্য যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরে ১০০% স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না।
আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে যে, আমরা অনেক সময় ইতিমধ্যে নষ্ট করেছি। আর একটি দিনও যেন অবহেলা ও সিদ্ধান্তহীনতাই নষ্ট না হয়। ঘোষিত আগামী ১৩ জুনে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায়। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, ২০২১ সনের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে। সুতরাং এই দুটো পরীক্ষা নিয়ে আর কোন সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। ইতোমধ্যে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত সিলেবাস বা সংক্ষিপ্ত প্রশ্নপত্র দ্বারা জুলাই’২১-এ এসএসসি এবং আগস্টে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে শুধুমাত্র অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে হলেও পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। আর যদি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে ‘অটোপাস’ দেওয়ার বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ করোনাসংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়-তাহলে শিক্ষার্থীদের এক জায়গায় বেঁধে রাখা কোন অবস্থাতেই যুক্তিযুক্ত হবে না। (অটোপাস নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, জট নিরসনে এটাই ভাল সমাধান বলেই ধারণা করা হচ্ছে)। এদিকে গত ২৭মে বহুল প্রতীক্ষিত ২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাস (পুনর্বিন্যাসকৃত পাঠ্যসূচী) প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রকাশিত নতুন পাঠ্যসূচী মোতাবেক ২০২২ খ্রি: অনুষ্ঠিত এসএসসি সিলেবাস ১৫০ দিন ও এইচএসসি সিলেবাস ১৮০ দিন পাঠদান শেষে, পরীক্ষা দুটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সনের পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাস থাকলেও তা বাস্তবায়ন ও পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।
শিক্ষাক্ষেত্রে পৃথিবীর সব দেশ এগুচ্ছে, কিন্তু আমরা হয় থমকে আছি বা পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদেরকে অবশ্যই এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে। এর এজন্যই করোনা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য ‘অনলাইন শিক্ষার’ পাশাপাশি ‘বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি’ উদ্ভাবন অতীব প্রয়োজন বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল