প্রিয়জনের একটি চিঠির অপেক্ষায়

কুমুদিনী কলি | রবিবার , ২৩ জুলাই, ২০২৩ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্যের সব শাখার মতো চিঠি লেখাতেও রবীন্দ্রনাথ সমান দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তাঁর এক একটা চিঠি বাংলা সাহিত্যের এক একটা বদ্ধ কপাট উন্মোচন করেছিলো। তাঁর উল্লেখযোগ্য চিঠিগুলোর মধ্যে এই চিঠিটা আমার খুব পছন্দের। শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগকে লিখিত

কল্যাণীয়েষু,

ঘোর বাদল নেমেছে। তাই আমার মনটা মানবইতিহাসের শতাব্দী চিহ্নিত বেড়ার ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে। আকাশরঙ্গ ভূমিতে জলবাতাসের মাতনের যুগযুগান্তর বাহিত স্মৃতিস্পন্দন আজ আমার শিরায় শিরায় মেঘমল্লারের মীড় লাগিয়েছে। আমার কর্তব্যবুদ্ধি কোথায় ভেসে গেল, সমপ্রতি আমি আমার সামনেকার ঐ সারবন্দী শালতালমহুয়াছাতিমের দলে ভিড়ে গেছি। প্রাণরাজ্যে ওদের হল বনেদি বংশ, ওরা কোন্‌ আদিকালের রৌদ্রবৃষ্টির উত্তরাধিকার পুরোপুরি ভোগ করে চলেছে। ওরা মানুষের মতো আধুনিক নয়, সেইজন্যে ওরা চিরনবীন। সেইজন্যেই বর্ষা পড়ে অবধি আমি হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির সঙ্গে গাছপালার সঙ্গে গান তৈরি করছিআজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে,/ আমার ভাবনা যত উতল হল অকারণে’। একটা সময় ছিলো চিঠি ছাড়া যোগাযোগ করার বিকল্প কিছুই ছিলো না। প্রিয়জনের একটি চিঠির অপেক্ষায় থাকতে হতো দীর্ঘ সময়। আর তাতেই রচিত হতো হাসি, আনন্দ, বেদনার মহাকাব্য।

বাংলা সাহিত্যে চিঠির অবদান কোনো ক্ষেত্রেই কম নয়। প্রত্যেক কবি সাহিত্যিকদের বিখ্যাত বিখ্যাত চিঠি আছে। এখন প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ‘চিঠি’ শব্দটিই যেনো হারিয়ে গেছে। কোথায় সেই অপেক্ষা, চিঠি পাবার উন্মাদনা। এ প্রজন্ম সে সব চেনেই না। আসুন সবাই আবার চিঠি লিখাতেই অভ্যস্ত হই। প্রিয়জনের সাথে কাগজে কলমে ভাব বিনিময় করি। চিঠিকে বাঁচিয়ে রাখি। চিঠি লেখা খুব শৈল্পিক একটা সৃষ্টি। চিঠির মাধ্যমে একজনের প্রতি আরেকজনের যে আবেগ প্রকাশিত হতো, এখন তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ ও তার দৈনন্দিন কর্মজীবন। বিজ্ঞানের বদৌলতে চিঠির বিকল্প হিসেবে স্থান দখল করেছে বহুমাত্রিক মাধ্যম। তাই চিঠি লিখে তা পৌঁছে দেবার সেই সময় সাপেক্ষ কাজে সময় নষ্ট করার মতো বোকামি আজকাল আমরা আর করি না। সময় বাঁচানোর জন্য বর্তমানে মানুষের হাতে নানা বিকল্প পদ্ধতি। কিন্তু তারপরও যখন দেখি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে চিঠির সেই গৌরবময়তা ফিরে এসেছে, সত্যিই অভিনব মনে হয় সেসব অনুষ্ঠান আর তার আয়োজনের নেপথ্যের লোকগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রমকে। গত ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ভালোবাসার প্রিয় মানুষের কাছে চিঠি লেখার এমন একটা আয়োজন ছিলো চট্টগ্রামের জামালখানে। আয়োজক হিসেবে ছিলেন জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর জনাব শৈবাল দাস সুমন। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এর আয়োজনে ‘ভালোবাসার পত্র লেখো’ এই শিরোনামে খোলা চিঠি আহবান করা হয়। এই আয়োজনটা খুব ভালো একটা প্রভাব ফেলেছিলো। অন্ততপক্ষে মানুষ চিঠি লেখার একটা তাগিদ অনুভব করতে পেরেছিলো। প্রায় ছয়শতের অধিক চিঠি জমা পড়েছিলো। তার মানে এই এতগুলো লোক চিঠি লিখেছিলো। একদিনের জন্য হোক অথবা পুরস্কার প্রাপ্তি যাই হোক না কেনো মানুষ ফিরে গেছে সেই পুরোনো আবেগে।

এটাই বা কম কী! যান্ত্রিকতার এই কঠিন সময়ে এই ধরনের নান্দনিক আয়োজন এক পশলা শীতল, নরম হাওয়ার মতো জীবনে আনন্দের বার্তা এনে দেয়, আর কানে কানে বলেভালোবাসি, ভালোবাসি!

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃক্ষরোপণ
পরবর্তী নিবন্ধনাড়ী