বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের বিষয়টি ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সবগুলো সূচকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের পরামর্শ মেনে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছানোর আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকার কথা জানিয়ে গতকাল ঢাকা সফররত সংস্থাটির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি পাল্টানোসহ যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলোর সব পূরণ না হলেও ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক জানিয়েছেন, ঋণ দেওয়ার সময় সমঝোতাকালে আইএমফের চাওয়া অনুযায়ী পরবর্তী মুদ্রানীতিতেই সুদহার নির্ধারণে করিডোর চালুর ঘোষণা দেওয়া, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ গণনার হিসাবে বদল আনা এবং বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে একক হার নির্ধারণের কাজ চলছে। খবর বিডিনিউজের।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সব শর্ত পূরণ না হলে যে ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া যাবে না তা নয়। দেখতে হবে আমরা ঋণ কর্মসূচির সঠিক পথে রয়েছি কিনা। আমরা এখনও সঠিক পথেই আছি। আগে–পরে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির সব মানদণ্ডেই পৌঁছাতে পারব।
চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, রিজার্ভ হিসাব করা ও টার্গেটে পৌঁছাতে পারার একটা ইস্যু আছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা মহামারী দেখেছে, তার একটি চাপ আছে, মূল্যস্ফীতি ও ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ তো রয়েছে। এর মধ্যে শুধু করোনার চ্যালেঞ্জটি নেই। তার সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জ।
সব নির্বাচনের সময় অর্থনীতির গতি কমে আসে জানিয়ে মেজবাউল হক বলেন, এ সময় সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এজন্য কিছু জায়গায় আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এটা ট্রু। আমরা আশা করছি এগুলো সমাধান করার মতো যথেষ্ট সময় আছে।
রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত মানে আসতে সময় লাগলেও বিশ্ব ব্যাংক ও জাইকা যে ঋণ অনুমোদন করেছে সেটির একটি অংশ আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়ে যাবে জানিয়ে মুখপাত্র আশা করছেন, তা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হবে।
গতকাল আমদানি দায় হিসেবে আকুতে (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) ১ দশমিক ১ বিলিয়ন পরিশোধ করা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে বড় কোনো দায় পরিশোধ করতে হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, আকু পেমেন্টের আগে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
ঋণের অর্থ ব্যবহার ও ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সামষ্টিক অর্থনীতির সংশ্লিষ্ট সূচকসহ অর্থনীতিতে থাকা চ্যালেঞ্জসহ ঋণের সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয় উল্লেখ করে মেজবাউল হক বলেন, ভূ–রাজনীতিতেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এগুলোও বিচার–বিবেচনা করছি। এজন্য আমদানি পর্যায়ে ও সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য আমরা নীতি প্রণয়ন করছি। যখন যেটা প্রয়োজন তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে।
ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের এবারের সফর শেষ হয়েছে গতকাল। এর আগে সংস্থাটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে দলটি সমাপনী বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আইএমএফের সঙ্গে ঋণের সমঝোতা অনুযায়ী অর্থনীতিতে নীতি ও কাঠামো সংস্কারের একাধিক শর্ত বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন বলে গত নভেম্বরে ঋণ সমঝোতার সময়ে জানিয়েছিল আইএমএফ। নানা কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের আগে গড়ে প্রতি মাসে আট বিলিয়ন ডলারের আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় বাংলাদেশকে। এ হিসাবে তিন মাসের আমদানি দায় মেটাতে নিট রিজার্ভ প্রয়োজন ২৪ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের রিজার্ভ হিসাবের পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী আগামী জুনে এ পরিমাণ রিজার্ভ থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
আগামী জুলাই মাসে ঘোষণা হতে যাওয়া মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ইন্টারেস্ট করিডোরের দিকে যাচ্ছি, এঙেচেঞ্জ রেট সিঙ্গেল রেটে যাচ্ছি। তা আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা করা হবে। আইনি বিষয়সহ যেসব বিষয়ে বাস্তবায়নে সময় লাগবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংস্থাটির প্রতিনিধিদলকে অবহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ সংশ্লিষ্ট সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের মান অর্জনে নেওয়া অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত সময় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইন রয়েছে। কিন্তু আমরা ট্র্যাকের মধ্যেই আছি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমাপনী বৈঠকের আগে এদিন সকালে এবারের সফরে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ ও ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বিবৃতি দেয় আইএমএফ। এতে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ, বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর অর্থনীতির ধীর গতি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এবং টাকার মানের ওপর প্রভাব ফেলবে। এই সফরে আমরা সাম্প্রতিক সময়ের সামষ্টিক অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেছি। ঋণ কর্মসূচিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রধান বিষয়গুলোর অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা করেছি।