ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। গত বিশ মাসে (২০২১ থেকে বর্তমান) ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক পথে পণ্য পরিবহনকালে পনের কোটি আটানব্বই লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। শুধু তাই নয় ছিনতাই কাজে বাধা দিতে গিয়ে তাদের হাতে চালকের প্রাণহানি ও ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে মহাসড়কে র্যাব ও হাইওয়ে পুলিশের টহল অভিযান আরো জোরদার করার জন্য চিটাগাং চেম্বার এবং আন্তঃজিলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রীসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন সেক্টরে নানাভাবে চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু আশানুরূপ কোনো সফলতা পায়নি। রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত পরিবহনে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) চালুর পরামর্শ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কখনও ফেব্রিঙের রোল, কখনও পোশাক তৈরির সরঞ্জাম কিংবা অর্ডার করা পণ্য শিপমেন্ট প্রক্রিয়ার আগেই চুরি হয়ে যাচ্ছে কাভার্ডভ্যান বা ট্রাক থেকে। যার ফলে বিদেশে শিপমেন্ট পরবর্তী বিদেশি ক্রেতারা তাদের অর্ডার করা পণ্য হিসাবমতো না পেয়ে অর্ডার বাতিল করে। এভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সুনাম বিনষ্ট হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। পোশাক শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কয়েকটি চক্র পরিবহন থেকে গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে নিচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রতি চালানেই মিলছে না ক্রয় করা পণ্যের এক তৃতীয়াংশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট অভিযান চালিয়ে একাধিক চক্রকে গ্রেপ্তার করলেও থামানো যাচ্ছে না চুরি। পণ্যের চালান বিদেশি ক্রেতার কাছে পৌঁছার পরই মূলত ঘটনা জানাজানি হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (গোয়েন্দা বিভাগ) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার দীর্ঘদিন ধরে পণ্য লোপাট চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে চোর চক্রের যোগাযোগ থাকায় এই কাজগুলো তারা সহজে করতে পারে। এটার কারণে কিন্তু বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত পরিবহনে জিপিএস চালু করলে এটা রোধ করা সম্ভব হবে। ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, সংঘবদ্ধ চোর চক্রটি প্রতিদিন একাধিক রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান থেকে চালক ও গাড়ির মালিকের যোগসাজশে কৌশলে কার্টন থেকে পণ্য চুরি করে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গার্মেন্টস পণ্য চুরিতে মূলত কাভার্ডভ্যানের চালকরাই জড়িত থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো গোডাউন ভাড়া করে চোরাই পণ্য রাখে চক্রের সদস্যরা। কোনো কাভার্ডভ্যান যেন মহাসড়ক ছেড়ে আশপাশের গোডাউনে ঢুকতে না পারে সেজন্য জিপিএস প্রযুক্তি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গার্মেন্টস মালিকদেরও এ বিষয়ে জানানো হচ্ছে। জিপিএস প্রযুক্তি লাগানো থাকলে কাভার্ডভ্যানটি অন্য পথে যাচ্ছে কিনা বা কোথাও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছে কিনা তা নজরদারি করা সহজ হবে।
জিজ্ঞাসাবাদে পণ্য লোপাট চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে, কাভার্ডভ্যান কুমিল্লা, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড বা চট্টগ্রাম শহরে ঢোকার পর সুযোগ বুঝে পুরো চুরির কাজ শেষ করা হয়। এসব জায়গায় তাদের নির্ধারিত ডিপোতে কাভার্ডভ্যান ঢুকিয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যেই চুরির কাজ শেষ করে। কাভার্ডভ্যানের সিলগালা করা তালা না ভেঙে তারা দরজার নাট খুলে ফেলে। তারপর ভেতরে থাকা কার্টন থেকে অর্ধেক পণ্য সরিয়ে নিয়ে পুনরায় স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। কোনো কার্টন থেকেই সব পণ্য সরানো হয় না। তিন ভাগের একভাগ বা অর্ধেক এভাবে পণ্য সরানো হয়। পরে আবার এসব পণ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বড় শপিংমলগুলোতে বিক্রি করা হয়। কিছু কিছু রফতানিও করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সদস্যরা আরো জানিয়েছে, অনেক কাভার্ডভ্যান চালক কারখানায় যাওয়ার আগে গাড়ির নম্বর প্লেট বদলে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি দিয়ে আসে। যাতে চুরির পর চালককে শনাক্ত না করা যায়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে চোরাই কাপড়ের রোলসহ তিন ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব। গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে কাভার্ডভ্যানে করে জেএম ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের এসব রোল ঢাকা নিয়ে যাওয়ার পথে তাদের আটক করা হয়। র্যাব জানায়, চালক জাহিদুল ইসলাম তার অপর দুই সহযোগী নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে কৌশলে ৩০০টি রোল থেকে ১১টি ফেব্রিঙ কাপড়ের রোল চুরি করে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে আবার খাতুনগঞ্জ পাঠানোর জন্য বুকিংয়ের চেষ্টা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি র্যাবের একটি দল এসএ পরিবহন বারৈয়ারহাট শাখায় মালামাল বুকিং করার সময় তিনজনকে আটক করে। পরে তাদের হেফাজতে থাকা ১১টি কাপড়ের রোল উদ্ধার করে।
গত বছরের ৪ অক্টোবর নগরীতে ওয়াশিং কারখানা থেকে পোশাক কারখানায় পৌঁছে দেওয়ার পথে ৮০০ পিস প্যান্ট চুরির অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বায়েজিদ থানা পুলিশ। উদ্ধার করে চুরি যাওয়া ৭২৫ পিস প্যান্ট উদ্ধার করে বলে জানিয়েছেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান। একই বছর ১৩ আগস্ট এ চক্রের ছয় সদস্য ধরা পড়ে র্যাবের হাতে, যারা কাভার্ডভ্যান থেকে গার্মেন্টসের মালামাল চুরি করতে সিলগালা করা তালা ভাঙতো না। চালককে হাত করে বিশেষ কায়দায় গাড়ির একপাশ খুলেই পণ্য সরিয়ে ফেলতো। এভাবে চুরি করা প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের মালামালসহ তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই দিন বন্দর থানার তালতলা, ধামগড়ের রি-রোলিং মিলস লিমিটেডে অভিযান চালিয়ে চুরি হওয়া ৪১ বস্তা ও ৫০৬ কার্টন গার্মেন্টস সামগ্রী, নগদ ৮২ হাজার টাকা, মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত দুটি কাভার্ডভ্যান, একটি প্রাইভেটকার ও ১০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ডভ্যানে পরিবহন করা রফতানি পণ্য অভিনব কৌশলে চুরি চক্রে রয়েছে কাভার্ডভ্যান চালক, চালকের সহকারী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ডিপো মালিক, নিরাপত্তাকর্মী, শ্রমিক, ক্রেতাসহ ৩৫ সদস্যের একটি চক্র। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা ছড়িয়ে আছেন। তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ঘটে একেকটি চুরির ঘটনা। চুরির জন্য টার্গেট নির্ধারণ করা হয় ঢাকা বা অন্য জায়গা থেকে রফতানির জন্য পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরুর পর। আবার মীরসরাই থেকে কাচপুর ব্রিজ পর্যন্ত কখনো সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে, কখনো আবার গাড়ির কাঁচে পাথর ছুঁড়ে তারা গাড়ি থামতে বাধ্য করে। এসময় দুতিনজন চালকের সাথে তর্কাতর্কি করতে থাকে। তারই সুযোগে পেছনে কয়েকজন গাড়িতে উঠে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে কার্টন খুলে একের পর এক তৈরি পোশাক বা অন্য মালামাল নিয়ে সটকে পড়ে। তবে বর্তমানে চালক হেলপারকে জিম্মি করে অথবা তাদের সহযোগিতায় ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। ছিনতাইয়ের তালিকায় তৈরি পোশাক, পোশাক তৈরির কাঁচামাল, রোল কাপড়, মসলা, গম, চাল, ডাল সহ নানাবিধ পণ্যবাহী গাড়ি রয়েছে। শুধুমাত্র এ পেশায় থেকে এদের একেকজন প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে নিজেরাই পরিবহন ব্যবসায় নেমে পড়ে।
অপর একটি সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে আগে থেকেই গোডাউন ভাড়া করে রাখে গার্মেন্ট পণ্য চোর চক্রের সদস্যরা। পণ্য পরিবহনকারী কাভার্ডভ্যানের চালকদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকে এই চক্রের সদস্যদের। পণ্যসহ কাভার্ডভ্যান নিয়ে ওইসব গোডাউনের সামনে যায় চালকরা। শ্রমিকদের মাধ্যমে কাভার্ডভ্যান থেকে পণ্যভর্তি কার্টন নামিয়ে গোডাউনে ঢোকানো হয়। এরপর কার্টন থেকে পণ্য বের করে নেয় তারা। তবে ওজন ঠিক রাখতে কখনও কখনও কার্টনের ভেতরে ইট-পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর চালকরা কার্টনগুলো পুনরায় কাভার্ডভ্যানে তুলে চট্টগ্রাম বন্দরের নির্দিষ্ট সিঅ্যান্ডএফের কাছে নিয়ে যায়। অপরদিকে আরেক কাভার্ডভ্যানে করে চোরাই পণ্য নেওয়া হয় ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে।