দুই চাকা বাদাবনের সমীপে

বাবর আলী | সোমবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

(পর্ব-৫)

আরেক দফা চা-জিলাপির পর পন্টুনে গিয়েই দারুণ একটা জিনিসে চোখ আটকালো। পন্টুনের উপরেই আছে ভ্রাম্যমাণ মানবিক লাইব্রেরি। দুইটা বেঞ্চির মাঝের অংশে আছে কাঠের একটা মাঝারী আলমারি। তাতেই সাজানো আছে বেশকিছু বই। চাইলেই এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারে যে কেউ। পুরনো বই নির্দ্বিধায় এখানে জমাও দেয়া যায়। নৌকার জন্য অপেক্ষার সময়টা কেউ চাইলে বই পড়ে কাটাতে পারে। বইয়ের পাতায় আলো খোঁজার উদ্যোগটা অসম্ভব মনে ধরলো। নৌকায় আবারো নদী পারাপার। এবারে শিবসা নদী। হড্ডা ফরেস্ট স্টেশনের বিপরীতের ছোট ঘাটটাতে নেমে পড়লাম। প্রবেশ করলাম দেশের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ উপজেলা কয়রায়। সানির চোখ আটকাল পাড়ের লাল কাঁকড়াগুলোতে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে কীভাবে সুন্দরবনে বিপর্যয় নামবে, সেটা সে লাল কাঁকড়ার উদাহরণ দিয়েই বুঝিয়ে দিল। ঘাটের পাশেই একটা বাঁশের তৈরি বেঞ্চি। সেখানটাতে বসেই স্থানীয় এক লোকের কাছে সুন্দরবনের বেশ কিছু গাছ হাতে-কলমে চেনা হলো। কেওড়া, বাইন আর গরান একদম চোখের সামনেই ছিল বলে সেগুলো খুব ভালোমতো চিনিয়ে দিলেন স্থানীয় সেই লোক। গাছ চিনে আর পথের সন্ধান নিয়ে আর ধন্যবাদ দিয়ে গাছ-বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌপথ থেকে আবার স্থলপথে।
ইটের সলিন রাস্তা ধরে এগোতে প্রথম দিকে বেশকিছু বসতির দেখা পাচ্ছিলাম। আরেকটু এগোতে হাতের বামে সুন্দরবন থাকলেও ডানদিকে বসতির জায়গা নিল বিশালাকার সব মাছের ঘের। সেসব শেষ হতেই এক জায়গায় বিশাল সব ক্যাকটাস দেখে আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা। এত বড় ক্যাকটাস রাঙামাটির বাঙালহালিয়াতে সর্বশেষ দেখেছিলাম। আকারে আমাদের মাথা ছাড়িয়ে যাওয়া ক্যাকটাসগুলো তার বিশালত্ব দিয়েই মস্তিষ্কের মধ্যে ছিল অনেকক্ষণ। মাথার উপরের সূর্যটা জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডে পরিণত হওয়ায় আরো একবার চা কাম কোক বিরতি নিতে হলো। চায়ের দোকানের লোকজন নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। এর মাঝেই একজন বললো, ‘এইসব সাইকেল চালানো খুব আরাম।’ সাথে সাথেই আপত্তির সুরে অন্যজন জানান দিল, ‘যত আরামই হোক। এ তো আর মোটরসাইকেল না যে চড়ে বসলেই হলো। প্যাডেল মারতে শক্তিই খরচা করা লাগে।’ মাছের ঘেরে চোখ রাখতে রাখতেই বানিয়াখালী। এখানে আবারো খেয়া পারাপার। এই খালটা খুব একটা চওড়া নয়। চোখের পলকেই খেয়া ওপারে নিয়ে গেলো।
খেয়াঘাটের একঝাঁক উৎসুক চোখকে দর্শক বানিয়ে আমরা রসালো একটা জাম্বুরা খেয়ে নিলাম যাত্রা শুরুর আগে। জায়গাটার নাম মহেশ্বরীপুর। সকাল থেকে সঙ্গী হওয়া মাটির রাস্তা অবশেষে পিছু ছাড়লো। এইবারে পিচ রাস্তা। হাতের বামপাশে একটু আগেই খেয়ায় পেরোনো খালটা। আর তার পরেই সুন্দরবন। রাস্তাটা বেশ মসৃণই বলা চলে। এক পিচ্চি হঠাৎ করে কোথা থেকে উদয় হলো একটা ফনিক্স সাইকেলে চেপে। পেছনের ক্যারিয়ারে তারই এক বন্ধু। রেস-রেস উত্তেজনায় বেশ কিছু দূর তুমুল গতিতে সাইকেল চালানো হয়ে গেলো সবার। শতরুপা নামক একটা পাড়ায় এসে আবার মাটির রাস্তাই সঙ্গী। এইদিকে একদম সুন্দরবন লাগোয়া বেশকিছু বসতি। সেসবের পাশ দিয়েই একসময় খোড়লকাটি বাজারে। দুপুরের খাবারের খোঁজ করতেই জানা গেল, এ বাজারে কোন ভাতের হোটেল নেই। তানভীর ভাই এক চায়ের দোকানের মালিককে ধরলেন দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। ডিম-ভাত হলেও কোন অসুবিধা নেই। তানভীর ভাইয়ের অনুনয় শুনেই চায়ের দোকানীর ক্যাশের পাশেই বসে থাকা আরেক ভাইয়ের মন গলল। উনি আমাদের অপেক্ষা করতে বলে নিজের বাড়িতে গেলেন বাড়ির নারীদের খাবার সারা হয়ে গেছে কিনা তার খোঁজ নিতে। খানিক বাদে এসে তার পিছু নিতে বললেন। খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের নাম খোকন। তার বাড়িতেই দুপুরের খাবারের আয়োজন। খোড়লকাটি বাজার থেকে মিনিট তিন-চারেক হাঁটতেই উনার বাড়ি।
সুন্দরবন এখান থেকে নিঃশ্বাস ফেলা দুরত্বে। এই বাড়ি আর সুন্দরবনের মাঝে আছে হাত বিশেক প্রস্থের ছোট্ট একটা খাল। ঘরের দাওয়ায় বসে খালের প্রেম কাদায় পা উঁচিয়ে নরম দাগ ফেলে চলতে থাকা কাঁকড়ার স্পষ্ট দেখা মেলে। বাড়ির টিউবওয়েলের ব্যবহৃত পানিটা গড়িয়ে গিয়ে মেশে সুন্দরবনের খালের সাথেই। হাত-মুখ ধুয়ে ডিম-ভাতের জন্য অপেক্ষা করতেই প্রথমে এল নাইলোটিকা মাছ। একটু পরে আরো এক পদের মাছ। সবচেয়ে জাঁকালো আইটেমটা এলো সবার শেষে। ধুন্দল দিয়ে কুচো চিংড়ি। এত মজাদার স্বাদের চিংড়ি আমি খুব কমই খেয়েছি। এই অমেরুদন্ডী প্রাণীর স্বাদ মুখে লেগে থাকবে অনেকদিন। তিন প্লেট ভাত গলধঃকরণ করে ক্ষান্ত দিলাম। অবশ্য বাড়ির লোকজনের ধারণা, আমরা লজ্জা পেয়ে খাবার কম খেয়েছি! ধুন্দলের পেয়ালাটা আমরা যে মূহুর্তেই হাপিস করে দিয়েছি, সেটা উনারা খেয়ালই করলেন না। সানি এই রাইডের শুরুর দিন থেকেই বলে আসছিল, ওর খুব শখ গ্রামের কোন চেয়ারম্যান তাদের বাড়িতে আমাদের নিয়ে খাওয়াবে! সুন্দরবনের নানান পদের মাছ দিয়ে টেবিল ভর্তি করে খেতে দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের নাটকের চরিত্র চ্যালেঞ্জার কিংবা ফারুক আহমেদের কন্ঠে বলবে, ‘বাপজানেরা, খাইতে বসেন। যদিও আয়োজন অতি সামান্য!’ ওর আশা কিছুটা হলেও পূর্ণ হলো।
খাবার খেয়ে সাথে সাথেই দৌড় দিলে লোকে দেশের একটি ‘বিভাগ চাই’ আন্দোলনে সম্পৃক্ত জেলার লোকেদের সাথে তুলনা করে! তারপরেও লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে খাওয়া শেষ করেই পড়িমরি করে দৌড় দিতে হল বৃষ্টি নামায়। বাজারে গিয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা ব্যাগ আর প্যানিয়ার বাঁচাতে হবে। অবশ্য বাজারে পৌঁছে দেখি বাজারের লোক উদ্যোগী হয়ে চায়ের দোকানের ভেতরে সাইকেলগুলো ঢুকিয়ে নিয়েছে। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা তিন যুবকের জন্য লোকের দরদ দেখেই মন ভরে গেলো। এইসব ছোটখাট ব্যাপার এত আনন্দ দেয়। বৃষ্টির ছাঁট বেড়েছে খুব। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তানভীর ভাইকে বললাম, খোকন ভাইকে দুপুরের খাবার বাবদ খরচাটা বুঝিয়ে দিতে। খাবারের খরচের কথা তুলতেই খোকন ভাই রে রে করে উঠলেন। তার এক কথা, আজ উনার বাড়িতে আমাদের রিজিক ছিল বলেই আমরা এই সময়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় এই বাজারে হাজির হয়েছি। দোকানে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খোকন ভাইয়ের ছোট ছেলে ইয়াছিন আরাফাতের সাথে গল্প হচ্ছিল। তার প্রিয় কাজ সুন্দরবনে খালে মাছ ধরা। খোকন ভাই আমাদের ধরলেন তাকে পড়াশোনা নিয়ে উপদেশ দিতে। তানভীর ভাই উল্টো বললেন, ‘ওরে বুঝাব কি! আমার বাড়ি এমন বনের ধারে হলে আমি নিজেই পুরাদিন খালে মাছ ধরতাম!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধচোখের জলে ভেজা লাল পতাকা