পরপর দুটো ঢিল পরার পর একটু বিরতিতে আবার একটা… সাথে সাথে শতছিন্ন চালের ফাঁক গলে পড়লো পুরনো শনের টুকরো, কাকের আধ খাওয়া ময়লা আর ইঁদুরের বিষ্টা।
অন্যদিনের মত ঢিল ছোঁড়ার সাথে সাথে আমিনা খাতুনের বাজখাই গলার স্বর আর ভেসে এলোনা।
শিমুলতলী বাজারের একটু দক্ষিণে গিয়ে পরপর দুটো মজা পুকুর।তার পাড় ঘেঁষে এগুলে আমিনা খাতুনের একচালা ঘর। জৈষ্ঠের খর রোদে শুকিয়ে যাওয়া পুকুরটায় পাতার ফাঁকেফাঁকে মুখ তুলে আছে গোটা কয় কচুরিপানার ফুল।তার থেকে হাত দুয়েক এগুলেই চারপাশে চারখানা বেড়ায় শনে ছাওয়া আমিনা খাতুনের ঘর।
মায়ে- ঝিয়ের সংসার। বাড়ি বাড়ি কাজ করে। যে দিনগুলোতে কারও ঘরে ডাক পড়েনা, ভিক্ষে করে চেয়ে চিতেই দিন চলে যায় মা-মেয়ের।
দেশ জুড়ে যখন যুদ্ধের দামামা বাজলো কোথাও আর কাজ জুটল না মা-মেয়ের। এখন আর ভিক্ষেও দেয়না কেউ। সেদিন দুপুর-বেলায় একমুঠো খুতের ফেনে কলমী শাক সেদ্ধ খেয়ে সবে শুয়েছে মা’য়ে- ঝিয়ে। হঠাৎ ধুপধাপ জুতোর শব্দে ভরে উঠলো আমিনা খাতুনের আঙ্গিনা।
চোখ মেলে কিছু বুঝে উঠার আগেই করিম মোল্লার হাঁকডাক কানে এল, শেফালির মা কি বাড়ি আছো? আমিনা খাতুন বললেন, মিয়ে ভাই কি কিছু বলবেন?
কুটনো বুদ্ধির শেয়াল পন্ডিতের মতো করিম মোল্লা ধীরে ধীরে তার প্রস্তাব পাড়লো। ‘দেহো দেখি কান্ড,খান সেনারা দত্ত বাড়ির পুকুর থেইকা বড় বড় মাছগুলান তুইলা নিল। ক্যাপ্টেন সাহেবের ইচ্ছা হইছে মজা কইরা বড় কাতল মাছের মাথাডা খাইব।
তারা হইলো আমাগো মেহমান, তাগো খুশির দিকে খেয়াল রাখাতো আমাগো লাইগা ফরজ।তুমি কি কও শেফালির মা’? শেফালির মা বুঝলো না তার কি কওয়া ফরজ। তাই সামনে পিছনে বার দুয়েক মাথা ঝাঁকিয়েই সম্মতি দিল।
‘তাইলে তোমার শেফালিরে আমগো লগে দ্যাও, একটু ভালা মন্দ রান্না কইরা দিব।’ এমন কথায় ছ্যাঁত করে উঠলো শেফালির মায়ের বুক। মূর্খসুর্খ হলেও মিলিটারিদের আখড়ায় মেয়ে পাঠানোর অর্থটা সে বুঝে। ফিরতি কথাতেই বলে ফেলে কি কন ভাইজান, শেফালিতো দুইটা ভাতো ভালো কইরা ফুডাবার পারেনা, সেই করবো খান সেনাগো লাইগা রান্না? তারছে চলেন আমি যাই, কয়েক পদের কইরা রান্না কইরা দিবানি। অগত্যা খকখক করে কেঁশে চোখের কোনায় আর একবার দেখে নিল শেফালির নধর দেহখান, শেফালি তাইলে পারবনা কইতাছ?
ক্যাম্পে আসার পর থেকেই চেনা অচেনা উঠতি বয়সের মেয়েদের ধরে আনতে দেখছে আমিনা খাতুন। আর সাথে সাথেই পরম করুণাময়কে স্মরণ করছে। জানেনা মেয়েটা পালাতে পারলো কিনা! একমাত্র মেয়েকে ফেলে আসার সময় তার সমস্ত চিন্তা চেতনাও যেন ওখানেই রেখে এসেছে। তাই বিশ বছর আগে বিধবা হওয়া একটা শরীরের উপর জনা আটেক হায়েনার কামড়ানো, আঁচড়ানো, মনের উপর তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারলো না।
হাঁটুমুড়ে একজায়গায় বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ দুটো ধরে এল।
গঞ্জে মাছ বিক্রি করতো ফজল মিয়া। ফেরার সময় ভালো দেখে মাছ, সদাইপাতি আর শেফালির জন্য লেবেঞ্চুস নিয়ে ফিরত, শেফালি ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়তো বাবার কোলে। বিয়ের ছয় বছর পরে শেফালি আসে আমিনার কোল জুড়ে। অর্থবিত্ত না থাকলেও সুখে টুইটুম্বুর ছিল আমিনা খাতুনের ঘর। ফজল মিয়া মেয়েকে সোহাগ করতে করতেই বলে, আমিনা মাইয়াডারে দেইখা রাইখো।
স্বপ্নের মধ্যেই দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো আমিনার। এক চৈত্রে হাজামজা পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল ফজল মিয়া।সেই থেকে আজ অবধি শত অভাবেও কোনদিন মেয়েটাকে কাছছাড়া করে নাই আমিনা। ভোর রাতে কার যেনো গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমিনা খাতুনের… মা… মাগো… একটু পানি… ছুটে গিয়ে দেখল… তার আদরের কন্যা… বিবস্ত্র হয়ে পড়ে আছে… ভেসে যাচ্ছে রক্তগঙ্গায়।
সেই থেকে কতদিন কাটলো ক্যাম্পের ভেতর, দিন তারিখের কোন হিসাব রইলো না।
একরাতে তুমুল গোলাগুলির শব্দ।করিম মোল্লা ক্যাপ্টেনের রুমে ঢুকে কি সব ফিসফাস করে বের হয়ে গেল। সেইরাতে খান সেনারা কেউ আর আসলোনা এদিকে। আমিনা খাতুন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো, দেইখো মা! এইবার আমরা স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচুম।
দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু স্বাধীন দেশে শেফালিরা অছ্যুত হয়েই রইলো,,তাদের জন্য আরও বেশি ঘৃণা জমা হল মানুষের চোখে,সমাজের চোখে।স্বাধীনের দিন দুয়েক পর রাতের বেলা আমিনা খাতুন হাতে পায়ে ধরে এক ধাই যোগাড় করে আনলো শেফালির গর্ভপাত করানোর জন্য।স্বল্পবিদ্যার ধাইমা তার বিদ্যাবুদ্ধি সব ঢেলে দিল কিন্তু সারারাত ধরে রক্তপাত বন্ধ করতে পারলোনা।শেফালিও পারলো না এক শরীরে এত ধকল সইতে। তাই স্বাধীন দেশের মাটিতে ভোরের আলোর সাথেই ঝরে পড়লো শেফালি… ঘুমিয়ে গেল সর্বোচ্চ মূল্যে মুুুক্তি কিনে আনা এক বীর!
পরদিন ভোরে আকাশ রাঙিয়ে উঠলো স্বাধীনতার লাল সূর্য। এক বীর মাতা তখন তাঁর বীর কন্যার নিথর মুখখানাতে শেষ আদরটুকুন মাখিয়ে দিচ্ছে চোখের জলে…