ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের পটিয়া সমহিমায় সমুজ্জ্বল এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ, শিক্ষা–দীক্ষা, সাহিত্য–সংস্কৃতি, রাজনীতি, জ্ঞান–সাধনা, গবেষণা, ক্রীড়া, ব্যবসা–বাণিজ্য, আন্দোলন–সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সর্বাধিক বিবেচনা করলে পটিয়ার অবদান অনস্বীকার্য।
পটিয়া জন্ম দিয়েছে ভারত–বাংলা খ্যাত অনেক অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাবিদ্দের যারা নিজেদের কর্মদক্ষতা ও কীর্তির জন্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলো ছড়িয়েছেন বীর প্রসবিনী পটিয়া বিপ্লবীদের চারণভূমি কিংবা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার। বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামের পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী ধলঘাটের বাগদণ্ডি গ্রামে ১৯৩৮ এর ২৮ অক্টোবর প্রফেসর রণজিৎ কুমার চক্রবর্তীর জন্ম। পিতা বিশিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞ ও সঙ্গীতজ্ঞ সজ্জন ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রমোহন চক্রবর্তী, মাতা দুর্গাবতী চক্রবর্তী।
সমকালীন ছাত্র–শিক্ষক যারাই রয়েছেন রণজিৎ স্যারের নাম জানেন না এ সংখ্যা খুবই কম। সুদর্শন বালক রণজিৎ কুমার চক্রবর্তীর লেখাপড়ার হাতেখড়ি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জন্মগতভাবে মেধাবী ছাত্র রণজিৎ বৃত্তি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যা শেষ করে পি. সি সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালখালী, চট্টগ্রামে ভর্তি হন। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এ স্কুল হতে ১৯৫৫ সালে ১ম বিভাগে বিশেষ বৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন।
প্রবেশিকা পাস করে তৎকালীন দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে কলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে এ কলেজ হতে ঢাকা বোর্ডের অধীনে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান নিয়ে ১ম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই কলেজ হতে ১৯৫৯ সালে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬১ সালে ২য় শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করে এম.এ পাস করেন। (এ বছর কেউ ১ম শ্রেণিতে পাস করেন নি)।
শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি তিনি ধ্বনিতত্ত্বের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। ফরাসি, আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় তাঁর দখল চোখে পড়ার মত ছিল। শিক্ষা জীবন শেষ করে মানুষ গড়ার মহান পেশা শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। শিক্ষাকতা জীবন নিজ স্কুল এবং পরবর্তীতে চক্রশালা হাই স্কুল, রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা নটরডেম কলেজ, ভোলা সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে সফলতার সাথে সকলের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীতে বান্দরবান সরকারি কলেজ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, কঙবাজার সরকারি কলেজ, রায়পুর সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সরকারি চাকরি জীবন হতে অবসরের পর আশালতা কলেজে রেক্টর পদে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক চট্টগ্রামের আলোকিত মানুষ প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলামের বিশেষ অনুরোধে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ইউএসটিসিতে (ইউনিভারসিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম) ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে অধ্যাপকের বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি সুনামের সাথে ইংরেজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখান হতেই তিনি তাঁর কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান।
অসম্প্রদায়িক চেতনার নিবিষ্ট সাধক, প্রগতিশীল সমাজ ভাবনার ও সংস্কৃতির ধারক, উদারচেতা কৃতি শিক্ষাবিদ, রণজিৎ চক্রবর্তী সুনামের সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদেশী ভাষা ইংরেজিকে তিনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য মনোরম করে তুলেছেন এবং শিখিয়েছেন।
রণজিৎ চক্রবর্তী একটি নাম, একটি অনুপম অধ্যায়। তিনি এমন একজজন দেবতুল্য পুরুষ, চলনে বলনে সুপুরুষ। যাকে দেখলে শ্রদ্ধায় মন ভরে যেত। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি, বক্তা হিসেবে ছিলেন শ্রোতাসম্মোহক। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অখণ্ড সাফল্যের অধিকারী ও এক অনুকরণীয় চরিত্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। শিক্ষা জীবনের প্রতি পরীক্ষায় তিনি অসাধরণ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন তেমনই প্রতিভাবান শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করে তৈরি করেছেন হাজার হাজার সুযোগ্য ছাত্রছাত্রী। তাঁর সুললিত উচ্চারণ, অসাধারণ কণ্ঠ ও বাচনভঙ্গি, ভাষায় অহংকার ছাত্রছাত্রীদের হৃদয় স্পর্শ করতো। ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে গিয়ে তিনি প্রায়ই প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলা সাহিত্য হতে আবৃত্তি করতেন। অবাধ বিচরণ ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেঙপিয়ার, মিল্টন ও বাইরনের কাব্যজগতে।
প্রফেসর রণজিৎ চক্রবর্তীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন লিখেন, ‘এই বিশাল সাহিত্যের অমৃত কুম্ভের রস তিনি ছাত্রদের যেভাবে পরিবেশন করতেন, শুনেছি তা ছাত্রদের যথার্থ অর্থেই অমৃতের আস্বাদ দিত। এমন একজন সার্থক শিক্ষক পাওয়া পরম গৌরবের, কারণ তা বহু নির্জীব মনকে সজীব করে তোলে, চেনা জগৎ থেকে অচেনা জগতে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য এসব শিক্ষক ছাত্রদের যে আলোর সন্ধান দেন, জীবন গভীরতার যে স্পর্শে নিয়ে আসেন তা তাদের উত্তর জীবনে ছায়া ফেলে। এ ধরণের শিক্ষকের সংসর্গে আসা, ক্লাসে বসার সৌভাগ্য সত্যিই বড় প্রাপ্তি, অবশ্য যদি সে ছাত্রের মধ্যে আলোর উপলব্ধির সক্ষমতা থাকে।’
দেশ বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ লিখেন, ‘রণজিৎ চক্রবর্তী আমার সহকর্মী। আনন্দময় সময় কেটেছে চট্টগ্রাম কলেজে এক সঙ্গে। ম্যাকবেথ পড়াতে যখনই সমস্যা হতো, ছুটে যেতাম অধ্যাপক রণজিৎ এর কাছে। ব্যাঙ্কো কি মঞ্চে আসবে? বৃদ্ধ রাজা ডানকানের বয়স কত!- এরকম রহস্য নিয়ে যেতাম রণজিৎ মৃদৃ হেসে বলতেন, জানেন সবই শুধু শুধু আমাকে বাজিয়ে দেখছেন। শেক্সপিয়র নিয়ে অনেক কথা, মেলা রহস্য! ইংরেজির অধ্যাপক রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী আমাকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করতেন। রণজিতের তুলনা হয় না। ছাত্রদের প্রাণের শিক্ষক রণজিৎ স্যার। ‘ক’ বিভাগের ক্লাসে ‘খ’ বিভাগের ছাত্ররা এসে বসে আছে। রণজিৎ স্যারের ক্লাস বলে কথা! আমি বিস্ময়ে দেখতাম; এত প্রিয়তা, এত সম্ভাষণ রণজিৎ স্যার পেলেন কোথায়!’
রণজিৎ চক্রবর্তী শিক্ষকতার বাইরে অনেক অনেক কাজ করেছেন। আমেরিকান নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, কবি মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট এর তিন সর্গ বাংলা অনুবাদ করেছেন। অন্যদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে সভা–সেমিনারে তিনি বক্তব্য রেখেছেন।
মনে প্রাণে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক ও কবি, অসংখ্য সাহিত্য রচনা করলেও শুধুমাত্র একটি কবিতা গ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থের নাম ‘নৈঃশব্দের শব্দ’। জ্ঞানের বাতিঘর ধর্মের শুদ্ধ সাধক কালোত্তীর্ণ আলোকিত মানুষ ছিলেন অধ্যাপক রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী ।
তিনি ছিলেন অসাধারণ এক বাগ্মী। তাঁর বক্তৃতা সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতো। ক্লাসে কিংবা সভায় উপস্থিত সকলে মনোযোগ সহকারে তাঁর সুললিত কণ্ঠের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনতেন। পুরো চট্টগ্রাম শহর, গ্রামে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি পরিচিত হয়েছেন একজন ধর্মীয় বক্তা হিসেবে। এক পর্যায়ে দেশের গণ্ডী পেরিয়ে কলকাতায় বক্তৃতা করেছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তিনি হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য ছাড়াও মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মসভায়ও যেতেন এবং সব ধর্মের সমন্বয়ের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর মধ্যে ধর্মবোধ ছিল তবে ধর্মান্ধতা ছিল না। মানুষের মাঝে তিনি প্রকৃত ধর্মবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার প্রয়াস চালিয়েছেন সবসময়। এ কাজে দিন রাত বিরামহীনভাবে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন।
আকাশের মত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী প্রফেসর রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী বিশ্বপ্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী অমোঘ সত্যে উত্তরায়ণ লগ্নে ০৮ মার্চ ২০১৭ সালে ইহলৌকিক দেহত্যাগ করে পরলোক গমন করেন।
তিনি আবহমানকালে শ্রদ্ধাবনত অন্তরে মানুষের কাছে স্মরণীয় এবং চির অমর হয়ে থাকবেন। তিনি এমন ব্যক্তি যিনি কালান্তরে গেলেও যুগান্তরের চলমান প্রবাহ তাঁকে অমরত্বের স্থায়ী আসনে বসিয়েছেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, নৈতিকতা, মানবিকতার সামগ্রিক সত্তা, সৃজনশীল মানসিকতা ও সংযমী প্রচেষ্টা আজও ইতিহাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে আছে, থাকবে অনন্তকাল।
সহায়ক গ্রন্থ; : সুদর্শন চক্রবর্তীর নামকরণ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘চট্টলজ্যোতি প্রফেসর প্রয়াত রণজিৎ চক্রবর্তী স্মরণে ‘কীর্তিশরণ”। প্রকাশকাল ১ জুলাই ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ এবং পটিয়া উৎসব স্মরণিকা দ্রষ্টব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।