স্থানীয়দের সাথে ওয়াসার বিরোধ

স্যূয়ারেজ প্রকল্প ।। মাটি ভরাটে বাধা, মিছিল-বিক্ষোভ ক্ষেত ও পুকুরের ক্ষতিপূরণ দাবি

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

প্রায় চার হাজার কোটি টাকার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরোধ তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা বেশ আগ থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু করলেও গতকাল একটি অংশে মাটি ভরাটের উদ্যোগ নিলে স্থানীয়রা বাধা দেয়। তারা তাদের ক্ষেত এবং পুকুরের ক্ষতিপূরণ দাবি করে মিছিল ও বিক্ষোভ করেন। তারা বলেন, মাত্র মাস খানেক সময় দেয়া হলে তাদের ফসলগুলো ঘরে তোলা সম্ভব হতো। এরপর তারা মাটি ভরাট করলে চাষীদের কোন সমস্যা হবে না। স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কাজ বন্ধ করে পিছু হটে। ‘স্থানীয়দের অবৈধ চাষাবাদে’ ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোন সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্রকল্পের স্বার্থেই দ্রুত মাটি ভরাট করতে হবে। এটি চট্টগ্রাম শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এই প্রকল্প নিয়ে ছেলেখেলার কোন সুযোগ নেই বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর স্যুয়ারেজ সিস্টেম গড়ে তোলার জন্য ১৯৬৩ সালে হালিশহর এলাকায় ১৬৩ একর ভূমি হুকুমদখল করেছিল ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তান আমলের হুকুমদখল করা ওই ভূমিতে দীর্ঘদিনেও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সাগর উপকূলের বিস্তৃত জমিটি অব্যবহৃত পড়ে ছিল। ওয়াসা থেকে লীজ নিয়ে স্থানীয় জনগণ বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে চাষাবাদ করে আসছিল। উত্তর দক্ষিণে ৪ হাজার ৫৫০ ফুট এবং পূর্ব পশ্চিমে ১৮২০ ফুট জায়গাটির বেশ কিছু এলাকা একেবারে নিচু। প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়া জায়গাটির কোথাও নানা ধরনের সবজি, কোথাও ধান এবং কোথাও কোথাও ডোবার মতো করে মাছ চাষ করা হচ্ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এই ভূমি নিয়ে ওয়াসারও তেমন কোন মাথাব্যথা ছিল না।
দীর্ঘদিন পর চট্টগ্রাম মহানগরীতে পরিকল্পিত স্যুয়ারেজ এবং ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। নগরীকে ছয়টি ক্যাচমেন্টে ভাগ করে একটি ক্যাচমেন্টের ব্যাপারে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রকল্প ব্যয় এবং টেন্ডার ডকুমেন্টস তৈরি করা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পৃথক দুইটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার একটিতে মানুষের বাসা বাড়ি থেকে পাইপ লাইন হয়ে আসা বর্জ্য পরিশোধিত হবে। দৈনিক দশ কোটি লিটার বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষমতা সম্পন্ন প্ল্যানটিতে পরিশোধনের পর বর্জ্য পরিবেশ সম্মতভাবে সাগরে ফেলে দেয়া হবে। অপর প্ল্যান্টটি ফেক্যাল প্লাসের ( বিশেষ ধরনের গাড়িতে বাসা বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য) মাধ্যমে সংগৃহিত দৈনিক ৩০০ টন বর্জ্য পরিশোধন করা যাবে।
প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বে-টার্মিনালের জন্য নির্ধারিত চ্যানেল এলাকা থেকে বিপুল পরিমান বালি উত্তোলন করে পুরো এলাকাটি ভরাট করা হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে এই ভরাট কার্যক্রম চলছে। জমিতে বালি ভরাটের আগে উক্ত এলাকটি পরিস্কার করে দিতে হয়। যাতে কোন ধরণের বর্জ্য মাটির তলায় না থাকে। গতকাল মাটি ভরাটের জন্য জায়গা পরিস্কার করতে গেলেই স্থানীয় কৃষকেরা বাধা দেন। তারা জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল এবং পুকুরের মতো ডোবাগুলোতে মাছ থাকার কথা উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। তারা ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কোন ধরনের বুলডোজার না চালানোর জন্যও আল্টিমেটাম দেয়।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানায়, জায়গাটি নিয়ে সিডিএর সাথে কিছু গোলমাল যাচ্ছিল। বিশেষ করে একটি ফিডার রোড নিয়ে দেখা দেয়া সংকটের মীমাংসা হওয়ার পর পুরো জায়গাটি বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে ফেলে ওয়াসা। দুই বছর আগে কৃষকদেরকে আর চাষ না করার জন্য বলা হয়েছিল। যে কোন সময় প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু করতে হবে বলে উল্লেখ করে কৃষকদের আর চাষাবাদ না করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু কৃষকেরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কথা না শুনে নিজেদের মতো করে চাষাবাদ করতে থাকে এবং বলে যে, কাজ শুরু হলে তারা সরে যাবে। কিন্তু গতকাল কাজ করতে গিয়ে স্থানীয়দের বাধার মুখে ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে পিছু হটতে হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক মোহাম্মদ মহসীন অভিযোগ করেন যে, তাদের বাপ দাদার সম্পত্তি ওয়াসা হুকুম দখল করেছে বহু আগে। ক্ষতিপূরণও পুরোপুরি দেয়া হয়নি। তারা চাষাবাদ করে আসছিল বহুদিন ধরে। হুট করে এখন তাদের ফসল এবং মাছ ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। ক্ষেতে ধানের শীষ এসেছে বলে উল্লেখ করে মোহাম্মদ মহসীন বলেন, এমন ধানের উপর বুলডোজার চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াসা। আমরা শুধু আমাদের ফসলের ক্ষতিপূরণ চাচ্ছি। আমরা ওয়াসার কাজে বাধা দিচ্ছি না। আমাদের ফসলের ক্ষতিপূরণ দেয়া হলে আমরা সরে যাবো।
বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার শীর্ষ প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ওই জমিতে চাষাবাদ করতে আমরা কাউকে বলিনি। বরং দুই বছর ধরে তাদের সরে যেতে বলেছি। তারা না সরে এতোদিন যা পেয়েছে তার সবটুকুই লাভ। প্রকল্প এলাকায় ফসলের বা মাছের জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোন সুযোগ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এখন তাদের ফসল বা মাছ তারা নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারি কাজে বাধা দেয়া অন্যায়। ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম গতকাল স্থানীয়দের বাধার মুখে কাজ বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা কোন অশান্তি চাইনি। তাদের বুঝিয়েছি। কিন্তু সরকারি কাজ তো আর থেমে থাকবে না। এটি শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে দ্রুততম সময়ে মাটি ভরাটের কাজ শেষ করতে হবে। মাটি ভরাটের পরই অবকাঠামোগত নির্মাণ শুরু হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি স্থানীয়দের অহেতুক জটিলতা তৈরি না করে চট্টগ্রামের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সকলের সহায়তা চেয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিএনএ পরীক্ষার পর দুই লাশ শনাক্ত, একজনের বিচ্ছিন্ন পা পরিবারের কাছে হস্তান্তর
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় তিন কোটি টাকার সরকারি জায়গা উদ্ধার