সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

: করোনা- কিশোর অপরাধ পাড়া মহল্লা এবং নগরজুড়ে।
: একদল শিশু কিশোর মিছিল করছিলো, দলের জন্য নয়, দলের একজন স্থানীয় নেতার জন্য। শ্লোগান ছিলো … ভাই এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে। মিছিল শেষ হওয়ার পর বুঝলাম দলের নাম। পথ এগুতে ঐ দলের বয়স্ক নেতাদের ক’জন বললেন, এখনো তাদের নাক টিপলে দুধ বেরুবে অথবা দুধের দাঁত পাড়েনি তারা বনে গেছে নেতা। আর এরা করছে দলের রাজনীতি। কিশোরগুলোর মাথার চুল, পোষাকের সাজ সজ্জা এবং হাতে নানা ধরণের রকমারি চুড়ি বা আংটি দেখে মনে হলো এরা কামারের দোকান থেকে বের হয়ে জংলি সেজেছে। এদের দেখলে মানুষ ভাবতে কষ্ট হয়। কারণ মাথার চুলে চিরুনি কখন পড়েছে সে কথা তারাও মনে করতে পারবে বলে মনে হয় না। হাতের নখের যে অবস্থা তাতে ধারণা জন্মাবে বহু মাস তারা জঙ্গলে ছিলো। এরা যখন পথ চলে তখন ভদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। তবে এদের হিংস্রতা শহর ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বাহাদুরি দেখানোর জন্য তাদের অনেকে প্রকাশ্যে সিগারেট খায়, স্টাইল করে ক্ষুস্তির মহড়া দেখায়, কুন্ডলি পাকিয়ে অন্যের মুখের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। এরা সবাই যে বস্তি থেকে উঠে আসা কিশোর তা নয় বরং এদের অনেকেই পাড়া-মহল্লা বা বিভিন্ন বহুতল ভবনের মালিকের সন্তান বা ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। তবে এরা হচ্ছে পিতা মাতার বখে যাওয়া সন্তান। ঘরে বাইরে এদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ওরা এখন কিশোর অপরাধী।
: কেন ওরা বখাটে বা কিশোর অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে?
: কেউ বলছেন পিতা-মাতার অতি আদর বা তাদের অবহেলা। অন্যদিকে নেতিবাচক রাজনীতির কুপ্রভাব। সমাজে এমন কিছু মানুষের অবস্থান থাকে যারা নিজের অপকর্ম ও পাপকর্ম নিজের হাতে না করে অন্যকে দিয়ে করায়। এদের বেশির ভাগই হচ্ছে কিশোর তরুণ, যাদের বিবেকী শক্তি দুর্বল থাকে। মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের পরিচয় দেই কিন্তু আমরা ক’জন প্রকৃত মানুষ! সিনেমা, নাটক এ ক্রাইম প্রতিবেদনে দেখা যায় অন্যের ক্যারিয়ার বা বাহক হিসেবে কিশোর তরুণরা কাজ করতে গিয়ে তারা সমাজ অপরাধী বনে যায়। ফেরার ইচ্ছা থাকলেও তারা ফিরতে পারে না। ততোদিনে তারা আইন শৃংখলা বাহিনীর নথিভূক্ত হয়ে আরো বড় ক্রিমিনালে পরিণত হয়। তখন তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না পায় পারিবার না পায় সংসার জীবন। রাজনীতির অপশক্তি এবং সমাজ অপরাধী প্রভাবশালীদের নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ে। তাদের জীবন থাকে অন্যের নির্দেশনায়। সাধারণ মানুষ সবই দেখেন কিন্তু বলতে পারেন না। কারণ এদের জন্য সংসার সুখ বিনষ্ট হতে পারে। তাই বেশির ভাগ মানুষ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে পরিবারের অন্য সদস্যদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না। এমনকি পুলিশকেও বলার সুযোগ পান না বা সাহস করেন না। এজন্যই অপরাধীরা দিনে দিনে সাহসী হচ্ছে। এদের সাধারণ মানুষ পছন্দ না করলেও কিছু মানুষ এদের পক্ষে থেকে জামিনের জন্য এগিয়ে আসে। বড় বড় পোস্টার পড়ে, ব্যানারে বিশেষণ দিয়ে নেতা বানিয়ে ফেলে। ফলে সে অপরাধী শিশু, কিশোর, তরুণ বনে যান নেতা। এভাবেই কিন্তু ঘরের ছেলেটি বনে যায় অপরাধী এবং হয়ে যায় গডফাদার। বিশেষ বিশেষ সময়ে এরাই সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
: এদের গতিবিধি লক্ষ্য করুন।
: কিছুদিন আগে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎপরতা এবং কোতোয়ালী পুলিশ ১৬ জন এমন কিছু শিশু কিশোরকে গ্রেফতার করেছে যারা নগরের বিভিন্ন স্থানের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছিলো। এদের কারণে কষ্ট পেত পথচারি পুরুষ, নারী এবং পথচারি কিশোরীরা। ভাসমান দোকানি থেকে খেয়ে টাকা না দেওয়া, পথরোধ করে টাকা আদায় করা, মানুষদের অপমান ও নির্যাতন করা। যেহেতু পথে তারা কোন প্রতিরোধ পায়না সেজন্য তারা একেবারে বেয়াড়ার জীবনে ছিলো অভ্যস্ত। যেহেতু তাদের এমন অপকর্মের সময় পুলিশ বা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায় না, প্রতিবাদী মানুষ থাকেনা- তাই তারা নিজেদের পথের রাজা, মহারাজা ভাবতে থাকে। তাদের হাত থেকে পথে ঘুরা ভিক্ষুকরাও রেহাই পায় না। ইদানিং কালে এদের পরিবারগুলোর হালচিত্র দেখুন। দেখবেন এদের পরিবার এদের খবর রাখে না। এদের জন্য কোন অভিভাবক কি বিশেষ কোন ভূমিকা রেখেছেন! যেমন ধরুন,
১. আপনার শিশু, কিশোর সন্তান দিনে রাতে কোথায় থাকে, কোথায় যায় সে খবর কি রাখেন?
২. তাদের বাইরের বন্ধু কারা এবং তাদের পরিবারের তথ্য কি জানেন?
৩. সে কখন কোথায় যায় সে তদারকী কি বাবা-মা করেন?
৪. সে কোথা থেকে টাকা পেলো বা তার টাকার উৎস কি- সন্তানকে জিজ্ঞেস করেছেন কি?
৫. রাতে বা দিনে কখন বাসায় ফেরে, দেরির কারণ কি- এতথ্য নিয়েছেন কি?
৬. প্রতিদিন ঘুম থেকে দেরিতে ওঠার কারণ জানতে চেয়েছেন কি?
এই প্রশ্নগুলো একেবারে সাধারণ মানের। তবে আমার ধারণায় প্রতিজন অভিভাবক এগুলো তার সন্তান থেকে জানার অধিকার রাখেন। আর যদি সে প্রশ্নগুলো জানার অধিকার সংরক্ষণ না করেন বা ভয় পান, চেপে যেতে চান তাহলে সন্তান ভালো হবে এ আশা করাটা অন্যায় হবে। যে ছেলেটি আজ সন্ত্রাসী বা যে মেয়েটি আজ নষ্ট পথে চলছে খোঁজ নিয়ে দেখুন তার পরিবার তার বা তাদের লজ্জাজনক ভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফলে তারা ছোট অপরাধ থেকে বড় অপরাধ করে বনে গেছে বড় অপরাধী। অনেক পরিবার আছেন যারা নিজ সন্তানের অপরাধটা দেখেন না, শুধু অন্যের সন্তানের অপরাধ খোঁজেন। কেউ শুভাকাংখী হয়ে পরামর্শ দিলে বলে আমার সন্তান কোন মন্দ কাজ করে না। ফলে আসকারা পেয়ে ছেলে হয়ে গেলো প্রথমে ধূমপায়ী পরে একেবারে মাদকসেবী। পথে ঘাটে পড়ে থাকে। তখনও এমন সন্তানের অভিভাবক বলেন, আমার সন্তানকে নষ্ট করেছে … ঐ বাড়ির বা ফ্ল্যাটের ছেলেটি। তারপরও তারা নিজের সন্তানের দোষ দেখেন না। এ প্রসঙ্গে একজন মাদকসেবী অপরাধী ছেলের গল্প বলছি। গল্পটি এরকম। ছেলেটিকে প্রথমে দিলো ইংরেজি স্কুলে, পরে স্কুল পাল্টে বাংলা স্কুলে, পরে আবার মাদ্রাসায়। ছেলেটি তার নিজের গতিপথ হারিয়ে ফেললো। হতাশায় পড়ে ধরলো ধূমপান, তারপর মাদকপান। অর্থের অভাব দেখা দিলে সে পাশের বাসার জুতা, কাপড়, ঘড়ি চুরি করে। অল্পদামে বেচে গ্রহণ করে মাদক। পরে অর্থাৎ নিজ বাবা-মা’র পকেট কাটা শুরু করে নিজের ঘরের মূল্যবান দ্রব্য বাইরে পাচার করে নেশার টাকা যোগাড় করতে লেগেগেল। নিজেতো শেষ হলো, এখন সে অন্যের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের পকেট কেটে প্রথমে ধরিয়ে দিলো সিগারেট এবং পরে মাদকের নেশা। এদের নিয়ন্ত্রণের পথ কি?
: উত্তর দেয়াটা কঠিন কিন্তু অসাধ্য নয়। আমার বিবেচনায় সূচনাতে পিতা-মাতাকে প্রথমে নার্সিং করতে হবে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি অন্ধ আবেগে অবগাহন করে। কারণ অতি ভালোবাসা বা স্নেহ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানদের বেয়াড়া করে তোলে। এই বেহায়া বা বেহায়াপনা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন পিতা-মাতা হয়ে পড়েন অসহায়। এই অসহায়ত্ব থেকে তারা বের হতে পারেন না। একজন সন্তানের আচরণ গতিবিধি পিতা-মাতা শৈশব থেকেই বুঝতে পারেন। তখন থেকে তারা যদি সচেতন হতেন তাহলে সন্তানের জীবনে নেমে আসতো না অমানিশার অন্ধকার। বিনা বাধায় সন্তান হয়ে যায় কিশোর অপরাধী পরে মাস্তান ও সন্ত্রাসী। এটাই হচ্ছে সমাজ বাস্তবতা। প্রয়োজন প্রতিজন শিশু সন্তানের নিয়মিত গতিবিধির প্রতি নজর দেয়া। আদর, সোহাগ থাকবে কিন্তু দেখে যেন সন্তান না বুঝে যে অন্যায় করলে বাবা-মা কিছু বলবে না। আপনার শিশু, কিশোর সন্তানকে নিয়মিত সময় দেবেন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশুদ্ধ রাজনীতির দ্যুতিময় হীরে
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ মুরিদুল আলম : মুক্তির অশঙ্ক চিন্তক