সাইকেলনা বিলাসী গাড়ি

মোস্তফা কামাল পাশা | সোমবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

দেশি বিদেশি মিডিয়ায় মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য সব খবর ভাসে। দেখে-পড়ে চমকাই সত্য, পরপরই দ্রুত মুছে ফেলি। কেউবা পানপাত্র হাতে অভিজাত আড্ডায় তাজা খবর নিয়ে নীতি-নৈতিকতার সবক দেয়। গুণ ও মানে আমরা কত পিছিয়ে, হায় আফসোসসহ অকাট্য যুক্তি শানাই। বাস্তবে থিতু হয়ে দেশের স্বার্থ পদচাপা দিয়ে আত্মস্বার্থ চর্চায় আরও বেশি বেশি মনোযোগ দেই।
খবরটা নিউজিল্যান্ডের। দেশটির ক্ষমতাসীন গ্রিন পার্টির সাহকেলপ্রেমী একজন এমপির সাহসিকতা মিডিয়া মনোযোগ কেড়েছে। নাম জুলি অ্যানি জেন্টার। অন্তঃসত্তা জেন্টার প্রসব বেদনা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে নার্সিং সেন্টারে ছুটে যান। ঘন্টার মাঝে ফুটফুটে স্বাস্থ্যবান সন্তান জন্ম দেন। সন্তানসহ বাসায় ফিরে নিজের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে বড় সংবাদটি পোস্ট দেন ছবিসহ। জেন্টারের এমন অভিজ্ঞতা প্রথম না, ২০১৮ সালে প্রথম সন্তানও এভাবে জন্ম দেন। লিখেছেন, ২৮ নভেম্বর দুপুরের পর প্রসব বেদনা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে নার্সিং সেন্টারে ভর্তি হন। স্থানীয় সময় ৩-০৪ মিনিটে সন্তান জন্ম দেন। সাইকেল চালাতে বেশ অস্বস্তি হয় তবুও উপভোগ করেছেন। কারণ সাইকেল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বাহন। জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক জেন্টার ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ডে এসে থিতু হন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা এর্ডার্নও কিছুদিন আগে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেন। মাতৃত্বকালীন ছুটির পরপরই তিন মাসের শিশুকোলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিস্ময় উপহার দেন, সদস্য দেশের নেতাদের। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ড। মিথ্যা ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসাবেও দেশটির অবস্থান শীর্ষে। ক’বছর আগে হঠাৎ রক্তে লাল হয়ে যায় দেশটির সবুজ নিসর্গ ক্রাইস্টচার্চ। জনৈক শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীর আকস্মিক গুলিবর্ষণে দুটো মসজিদে জুমার জামাতে নিহত হন অনুর্ধ্ব ৫০জন মুছল্লী। আহত হন প্রচুর। পৃথিবীজুড়ে তোলপাড় তোলে এই হত্যাযজ্ঞ। কিন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্থের পাশে এসে দাঁড়ান অনন্য সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে জেসিন্ডা এর্ডার্ণ মানবিক নেতৃত্বের মহান রোল মডেল হয়ে উঠে আসেন। আগে খুব কম মানুষই তাঁর নাম জানত। কিন্তু ক্রাইস্টচার্চ ট্রাজেডি রাতারাতি তাঁকে লাইমলাইটের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। যদিও শান্তির সবুজ দ্বীপ নিউজিল্যান্ডের মহান নেত্রী প্রচারের বাইরেই থাকতেন। এমনিতেই দেশটির প্রচলিত ট্রাডিশন হচ্ছে, ‘প্রচার নয় কাজ।’
ফিরি আপন ভুবনে। নিজের দেশের জমিতে দাঁড়িয়ে ঘটনাগুলোকে পরাবাস্তব বা স্বপ্নের মত লাগে। এদেশে কত কত ভিআইপি। প্রতি বছর সুইস ব্যাঙ্কের গোপন অ্যাকাউন্টে ধনাঢ্য ভিআইপির পাচার করা টাকার অঙ্ক স্ফীতকায় হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের পর বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও। বহু মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি, রিসোর্ট, শপিং মল, ফুডকোর্ট, কনভেনশন সেন্টারসহ ভোগের যোগান বাড়ছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় ২৫০০ ডলারে উন্নীত হলেও বৈষম্যের ফাঁক আকাশ পাতাল! এমন বৈষম্যকে অর্থনীতির ভাষায় কী বলে? বিশেষজ্ঞরাই ভাল বুঝবেন। নিউজিল্যান্ডের এমপি জেন্টারের কথাই ধরি। সাইকেল তাঁর প্রিয় বাহন। সংসদে যান, হাটবাজার করেন, এলাকার মানুষের ভালমন্দের খবর নেন- সাইকেল চেপেই। নার্সিং সেন্টারে ছুটতেও! আমাদের মাননীয় এমপিদের বড় অংশের বাহন বিনা শুল্কের বিলাসবহুল গাড়ি। সাথে প্রটোকলের বহরও । এম পি বা তাঁদের স্ত্রী থাক, নিকট আত্মীয় বা অন্য ভিআইপিদের সন্তান জন্ম দিতেও প্রটোকলের দামি গাড়ি ছাড়া চলেনা। ডাক্তার নার্সরাও থাকেন তটস্থ- খবরদারির যন্ত্রণায়। অন্য জনপ্রতিনিধি বা আমলারাও প্রায় একই সুবিধা নেন। আমরা জানি, এমপি মহোদয়রা আইন প্রণেতা। বাস্তবে তাঁদের খবরদারি তৃণমূল থেকে শীর্ষ সবখানেই। মন্ত্রী এম পিদের সহযোগিতাধন্য অন্য প্রভাবশালীও বেপরোয়া ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারেন এদেশে। চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। নজরদারির যেসব সাংবিধানিক বা প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান আছে, তারা হাওয়া বুঝে ছাতা ধরে।
ফলাফল, দেশে ব্যাক্তিগত যান পাবলিক পরিবহনের চেয়ে প্রায় ৫০গুণ বেশি। রাস্তার ধারণ বা সহন ক্ষমতা বিবেচনা ছাড়াই বাড়ছে ব্যক্তিগত যানের সংখ্যা। এতে বড় বড় নগরগুলোতে যানজটে লক্ষ-কোটি কর্মঘণ্টা বছরে অপচয় হয়। বেপরোয়া লোভ, ভোগ-বিলাস সুস্থ কর্পোরেট বা মুক্ত অর্থনীতি নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি বিকাশের মূলশর্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উন্নয়ন। ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে উৎপাদিত পণ্য বাজার পাবে না। আসলে দেশে যা চলছে, তা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির আধুনিক রূপ মাত্র, মুক্তবাজার বা কর্পোরেট অর্থনীতি নয়। শুধুমাত্র গার্মেন্টস ও বিদেশি রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতি খুবই ভঙ্গুর। যে কোন একটা সেক্টরে ধ্বস নামলে ধ্বসে পড়বে পুরো অর্থনীতি। কাজেই সবকিছু পাল্টে মানবিকতার চাষ ও দেশপ্রেমের নির্যাসে সুশাসনের শক্ত ভিত প্রতিষ্ঠা ও অর্থনীতি না সাজালে পতন ঠেকানো কষ্টকর হবেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র