শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন সমীপে- শ্রম আইন সংশোধনের কিছু সুপারিশ

ফজলুল কবির মিন্টু | বুধবার , ১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমজীবী মানুষের জন্য এই কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সমূহ চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সকল শ্রমিকের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠু শিল্পসম্পর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনগুলির পর্যালোচনা এবং সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি, এর মধ্যে প্রায় ৮৫ থেকে ৮৭ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে কোনো সুনির্দিষ্ট অধিকার সংরক্ষিত নেই। আবার শ্রম আইনের ধারা ১ এর উপধারা ৪ এর বিভিন্ন দফায় কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যেমন অসুস্থ্য, অক্ষম, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, এতিম, বিধবা মহিলাদের চিকিৎসা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস, মেস, হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ৫ জনের কম শ্রমিক সম্বলিত ছোট ছোট কৃষি খামার সমূহে শ্রম আইন প্রযোজ্য নয় উল্লেখ থাকায় প্রশ্ন আসে, এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত হবে? এই বৈষম্য দূর করতে হলে, শ্রম আইনকে গণতান্ত্রিক, সর্বজনীন এবং শ্রমিকবান্ধব হিসেবে সংশোধন করতে হবে। বিশেষভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় নিয়ে আসা শ্রমিক অধিকার কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

২০১৩ সালের সংশোধনীতে শ্রম আইনে শ্রমিকের সংজ্ঞায় তদারকি কর্মকর্তাদের শ্রমিক হতে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, গার্মেন্টস শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে সুপারভাইজার পদবীধারী শ্রমিকরা শ্রমিক হিসেবে গণ্য না হওয়ায় তাদের অতিরিক্ত কাজের জন্য কোনো মজুরি বা সুবিধা প্রদান করা হয় না। দৈনিক ১২/১৪ ঘণ্টা কাজ করেও তারা অতিরিক্ত মজুরি বা সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। শুধু তাই নয়, শ্রম আইনে বর্ণিত কোন অধিকারই তারা পায় না। এমনকি চাকুরি অবসানে কোন ক্ষতিপূরণও তারা পায় না। এই সব বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে কার দ্বারস্থ হবে সেটাও কারও জানা নেই। এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রম শোষণের উদাহরণ। এমনকি, শ্রম আইনের ৩() ধারায় ঠিকাদারের অধীনে যে শ্রমিক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে তা কেবল অস্থায়ী শ্রমিক এবং সিকিউরিটি গার্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে (তবে সিকিউরিটি গার্ড তার নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে বিবেচিত হবে) এছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী পদের বিপরীতে ঠিকাদারের অধীনের কোন শ্রমিক নিয়োগের বিধান থাকা উচিত নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রম আইনের ১৩ ধারা, যেখানে উল্লিখিত আছে যে, কোনো প্রতিষ্ঠানে বেআইনী ধর্মঘটের কারণে যদি প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে ধর্মঘটের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা কোন মজুরি পাবে না। বাকীরা শুধুমাত্র তিন দিনের লেঅফের সমপরিমাণ মজুরি পাবেন। আমাদের শংকা হচ্ছে, মালিকপক্ষ এই সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গণ্ডগোল সৃষ্টি করে পুরো কারখানা বন্ধ করে দিতে পারেন, যার ফলে শ্রমিকদেরকে মজুরি বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেকার হয়ে থাকতে হতে পারে। এমনকি, এই আইনের মাধ্যমে মালিক পক্ষ কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখার সুযোগ পাবে।

শ্রম আইনের ২৩ এবং ২৪ ধারায় কোন শ্রমিকের অসদাচরণের শাস্তির বিধান রয়েছে, যেখানে শ্রমিকের অসদাচরণ বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শাস্তি দেওয়ার বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই শাস্তির প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি স্পষ্ট নয়। কোন ধরনের অপরাধের জন্য কী শাস্তি হবে তা সুনির্দিষ্ট না থাকায়, বেশিরভাগ সময় শ্রমিকদেরকে যে কোন লঘু অপরাধের জন্যও সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে বরখাস্ত করা হয়, যদিও আইনে বরখাস্ত ছাড়া আরো ৭ ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। এর মধ্যে অপসারণ, পদাবনতি, পদোন্নতি বন্ধসহ নানা ধরনের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হলেও প্রায় ৯৯% ক্ষেত্রেই কেবল বরখাস্তই করা হয়। এর ফলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং এই প্রক্রিয়া প্রায়়ই অত্যন্ত কঠোর এবং অযৌক্তিক হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া, ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণীত হওয়ার সময় বরখাস্ত এবং অপসারণ উভয়ের ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণের কথা উল্লেখ ছিল। তবে মাত্র ৭ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান পরিবর্তন করা হয় এবং বিশেষভাবে ’বরখাস্ত’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ’অপসারণ’ শব্দটি রাখা হয়। এর ফলে এখন যদি কোনো শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়, তবে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি আইনগতভাবে স্পষ্ট নয়, যা এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

অন্যদিকে, একই সংশোধনীতে কিছু নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য শ্রমিককে বরখাস্ত করা হলে তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না উল্লেখ আছে। এসব অপরাধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেমালিকের সম্পত্তি চুরি, আত্মসাৎ, প্রতারণা, উচ্ছৃঙ্খলতা, দাঙ্গাহাংগামা, অগ্নিসংযোগ বা ভাংচুর ইত্যাদি। এর মানে হল যে, যদি শ্রমিক এসব অপরাধে জড়িত হন এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ থাকে, তাহলে তাকে বরখাস্ত করা হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

তবে, যদি কোনো শ্রমিককে অন্য কোনো অসদাচরণের কারণে বরখাস্ত করা হয়, তখন সে ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারে। কিন্তু আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে কিছু আইনজীবীর ভুল ব্যাখ্যা, মালিকপক্ষের অজ্ঞতা অথবা ক্ষতিপূরণ প্রদানে অনীহার কারণে বরখাস্তকৃত শ্রমিকরা তাদের আইনি পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। তাই বিভ্রান্তি নিরসনকল্পে বরখাস্তের ক্ষেত্রে ২০০৬ সালের ক্ষতিপূরণের বিধান শ্রম আইনে পুনর্বহাল করা উচিৎ।

শ্রম আইনে, মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। অভিযুক্ত শ্রমিককে তার পক্ষের প্রতিনিধি কারখানার অভ্যন্তর থেকে নিয়োগ দিতে হয় বিধায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শ্রমিক তার পক্ষের প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়। এতে দেখা যায় শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি ছাড়াই অধিকাংশ তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে হয়। আবার শ্রমিক পক্ষ প্রতিনিধি নিয়োগ দিলেও তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অনেক সময় তাদের অভিজ্ঞতারও ঘাটতি থাকে। ফলে মালিক পক্ষ তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত করার সুযোগ পায়। এতে অভিযুক্ত শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শংকা থাকে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে শ্রমিক চাইলে তার পক্ষের প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠানের বাহির থেকেও নিয়োগ দিতে পারবে এমন সুযোগ থাকা উচিৎ।

এছাড়া, ছাঁটাই, ডিসচার্জ এবং অবসানজনিত চাকুরীচ্যুতির কারণে ক্ষতিপূরণের বিধানকে আরও পরিষ্কার করা দরকার। শ্রম আইনে বলা হয়েছে, চাকুরী ছাঁটাই, ডিসচার্জ অথবা অবসানের সময় ‘চাকরির ক্ষতিপূরণ অথবা গ্র্যাচুইটি, যদি প্রদেয় হয়, যা অধিক হবে’ উল্লেখ থাকায় গ্র্যাচুইটি একটি অর্থহীন বিষয় হয়ে পড়েছে, কারণ অদ্যাবাধি কোনো শ্রমিকের চাকরি ছাঁটাই, ডিসচার্জ অথবা অবসানের সময় গ্র্যাচুইটি পাওয়ার নজির আমার জানা নেই। তাই, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে গ্র্যাচুইটির বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত, এবং শ্রমিক স্বেচ্ছায় চাকরি ইস্তফা দেওয়ার সময়ও একই নিয়ম কার্যকর করা উচিত।

বর্তমানে, শ্রমিক যদি স্বেচ্ছায় চাকরি ইস্তফা দেয়, তাহলে ৬০ দিনের নোটিশ দিতে হয়। আমি মনে করি, এই নোটিশের সময়সীমা কমিয়ে ৩০ দিন করা উচিত, যা শ্রমিকদের জন্য আরও সুবিধাজনক হবে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রম আইনের ২৭(৩ক) ধারা, যা অনেক শ্রমিককে হয়রানির শিকার করে। এই ধারার আরও পরিমার্জন প্রয়োজন, যাতে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং মালিকপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যায়।

শেষ পর্যন্ত, বাংলাদেশের শ্রম আইন এবং শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কিত এই আলোচনার মাধ্যমে, আমি মনে করি যে, যথাযথ আইনি সংস্কার এবং শ্রমিকবান্ধব নীতির মাধ্যমে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি উন্নত, সমতাভিত্তিক ও শ্রমিকবান্ধব শ্রম পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে সকল শ্রমিকের জন্য সমান সুযোগ এবং অধিকার নিশ্চিত থাকবে।

লেখক: বিলসডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ