মাতৃভাষাকে ভালোবেসে তার উন্নতির চেষ্টা করতে হবে

ফারজানা আজিম | রবিবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

সময়ের বিবর্তনে প্রতিবছরই বাঙালির অস্তিত্বে ফিরে আসে অমর একুশে। আমরা একুশ আসলেই আবেগাপ্লুত হই। গ্রন্থ মেলার আয়োজন করি, সভাসমাবেশ, আলোচনা বক্তৃতাবিবৃতি, ভাষণ, স্মৃতিচারণ আর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে শহীদদের স্মরণ করি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আবেগের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত।

বীরের রক্ত আর মায়ের অশ্রু, দেশবাসীর ভালোবাসা আর চৈতন্য, সংগ্রামশীলতা আর কষ্ট স্বীকার এ দেশকে গড়ে তুলেছে। বিনিময়ে এদিনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ভবিষ্যতের চলার পথে ইঙ্গিত আর একত্রিত হবার স্থান।

বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও আবেগ অপরিসীম। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মহতি দানের এমন দুর্লভ নিদর্শন পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা জানি না। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষার প্রতি এই অকৃত্রিম দরদবোধে আমরা তাড়িত হই এবং এ মাসে নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি সম্পন্নকরণের ভেতর দিয়েই মায়ের ভাষার প্রতি সব দায়দায়িত্ব পালন হয়ে যায়, এমনটিও অনেকেই ধরে নেন।

প্রতিবার একুশ আসে আর প্রশ্ন রেখে যায়, কতটা এগিয়েছে বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশ? প্রতিবার একুশ প্রেরণা জুগিয়ে যায় অধিকার, গণতন্ত্র আর ন্যায়ের সংগ্রামের। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালি তরুণদের আত্মদান শুধু বাংলাদেশ বা বাঙালির নয়, তা এক বিশ্বজনীন ঘটনা। একুশের উৎস থেকে জেগে ছিল গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন, সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দানা বেঁধেছিল সংগ্রাম।

স্বাধীনতার সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষা অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে।

বাঙালির অমর একুশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের এদেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতির পাশাপাশি সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা প্রকাশের সুযোগ অবারিত রাখা প্রয়োজন। ভাষার অধিকার মানে শিক্ষার অধিকারও বটে। ভাষার সঙ্গে শিক্ষার যে সম্পর্ক, শিক্ষার সঙ্গে সম্পদ ও ক্ষমতারও সেই সম্পর্ক। দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর ও শিক্ষা বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের জীবনে শিক্ষা ও সম্পদের অধিকার না এলে একুশের অর্জন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আজও জাতীয় জীবনের সর্বস্থরে বাংলা ভাষার প্রবর্তন হলো না। সরকারি কাজকর্মে বাংলা চালু থাকলেও ব্যবসাবাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ইংরেজিরই প্রাধান্য। বাংলায় আইন প্রণীত হচ্ছে কিন্তু উচ্চ আদালতে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিদ্যালয়ে বাংলা অবহেলিত। ইংরেজি মাধ্যমের এর কাছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের কুণ্ঠিত করে রাখার প্রায়সও চলে।

আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ভাষা পরিকল্পনা। ফেব্রুয়ারি মাস সংস্কৃতির উৎকর্ষ ও নবায়নেরও মাস। এ মাসজুড়ে সারা দেশে নানা ধরনের অনুষ্ঠান চলে। ঢাকায় মাসব্যাপী বইমেলার উৎসব চলে। আজ সারা পৃথিবীর বাংলাভাষীরা ভাষা শহীদের স্মরণে যে প্রভাতফেরীগুলো নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাবেন তা আসলে যাবে জাতির আত্মাকে জাগরিত করতেও। তবে একুশের চেতনা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা চলে না। সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন এবং বাংলাদেশের বাংলাসহ সব ভাষাভাষীর গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা না করে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন কী করে হবে? তাই মাতৃভাষাকে ভালবাসুন, তার উন্নতির চেষ্টা করুন, তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোনভাষাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করুন। কোন ভাষার মৃত্যু হয় কখন? যখন সে ভাষার সঙ্গে বৃহৎ জনপ্রবাহের বিচ্ছিন্নতা ঘটে।

সে দিক থেকে আজ এ কথা মনে করে আশ্বস্ত হবার কারণ আছে যে, জনসাধারণ যে গভীর আবেগ ও ভালোবাসার সঙ্গে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করেছে তাতে এই ভাষার মৃত্যু নেই। আজ বারবার শুধু এ কথা মনে হচ্ছে যে মৃত্যু নেই আমার বাংলা ভাষার। তেমনি মৃত্যু নেই তাদের, যারা আপন দেহকে বর্ম করে এই ভাষার প্রতি আঘাত নিবারণ করে শহীদ হয়েছেন।

এই ভাষায় কথা বলে আমরা ধন্য। এই জনসাধারণের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে ধন্য। এই ভাষার জন্য একত্রিতভাবে শপথ নিয়ে ধন্য আর ধন্য আজ এই মহান শহীদের উদ্দেশ্যে নিজেদের শ্রদ্ধা অর্ঘ্য নিবেদন করতে পেরেছি বলে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুকুর ভরাট বন্ধ হোক
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা ভাষা বিশ্বের নানা দেশে সমাদৃত