মাইজভাণ্ডারী গানের ভুবনে- রীনা মন্দাকিনী

বদরুননেসা সাজু | বৃহস্পতিবার , ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:১২ পূর্বাহ্ণ


বাস্তবতার নিরিখে কোনো কোনো নারীর জীবন থাকে শতো বাধা বিপত্তি। এসব অতিক্রম করে অথবা এসবের মধ্য দিয়ে সংসারের সকল দিক সামলিয়ে নারীকে চাকুরিতে যেতে হয়। আবার যারা লেখালেখি করে, তাদের ধৈয্যের সাথে আরও কষ্ট করতে হয়। এভাবে কেউ কেউ লেখালেখিতে বহাল থাকে, কারো লেখা হয়তো বা বন্ধ হয়ে যায়! সেদিক থেকে অধ্যাপক রীনা আকতার ব্যতিক্রম। পারিবারিক নির্মল পরিবেশে স্বামী পুত্র কন্যার সম্মতি সহযোগে তাঁর লেখালেখি অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। তাই তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন মাইজভাণ্ডারী গানের ভুবনে: রীনা মন্দাকিনী নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁর মাতামহ/নানাজান আধ্যাত্মিক সাধক, মাইজভাণ্ডারী গানের প্রসিদ্ধ গীতিকার মাওলানা বজলুল করিম(র.) মন্দাকিনী(১৮৮১-১৯৫৩)। তিনি প্রাক্তন এম.পি. খ্যাতিমান মাওলানা লেখক ওবাইদুল আকবর(র.), এম.এ. (ডবল) কলিকাতা (১৯১৫-১৯৭২) সাহেবের পিতা। গোল্ড মেডলিস্ট মাওলানা ওবাইদুল আকবর মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন খ্যাতি লাভ করেন। বাংলা ইংরেজি আরবি উর্দু ফার্সি ভাষায় তিনি সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের লেখালেখির ঐতিহ্যধারা অধ্যাপক রীনার মাঝে ঝরণার মতো সতত প্রবহমান। তিনি চার শতাধিক আধ্যাত্মিক মাইজভান্ডারী গান লিখেছেন। সেগুলো সাজিয়েছেন চার খণ্ডে। বইগুলোর নাম হল-(১) আলোর আকাশ পথে (২) রহস্যের সুড়ঙ্গে (৩) গোলাপ জবার মাহফিলে (৪) রহস্যের গুপ্তদ্বার। এই চারটি বই থেকে বাছাই করে ২৮০ টি সংগীতের সমন্বয়ে রচিত বই ‘মাইজভাণ্ডারী গানের ভুবনে’’ রীনা মন্দাকিনী এতোদিনে আলোর মুখ দেখেছেন। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭০। অধ্যাপক রীনা মন্দাকিনী শুধু গীতিকার নন, মাইজভাণ্ডারী সাহিত্যের ধারায়ও রয়েছে তাঁর প্রতিশ্রুতিশীল সরব পদচারণা। তিনি মাইজভাণ্ডারী সাহিত্যাঙ্গনে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
আমাদের প্রিয় নবীজির নবুয়ত শেষে বেলায়ত জারির অনুক্রমিক ধারায় মাইজভাণ্ডার শরীফের অলি আওলিয়ার ঐতিহ্য ছন্দে ছন্দে অধ্যাপক রীনা উক্ত বইয়ে বিধৃত করেছেন। এসবের মধ্যে আল্লাহ রাসূল আওলিয়ার প্রতি ভক্তি, খোদায়ী দান অলির শক্তি মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় যুগে যুগে আবির্ভূত মাইজভাণ্ডারী অলি আওলিয়ার বংশানুক্রমে প্রাপ্ত ফকিরী বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। রীনার জন্মস্থান আজিম নগরের ইতিহাস, বিভিন্ন অলিকুল, মাইজভাণ্ডার সম্পৃক্ত আত্মীয়তা এবং পারিবারিক বংশধারা সম্পর্কেও পাঠক জানতে পারেন ঐ বই থেকে। রীনার জীবনের ঘাত প্রতিঘাত, ট্রাজেডি, স্বজন হারানোর আকুলতা মা হারানো, সন্তান হারানো হৃদয়ের ব্যথা সেখানে মুনিব-মুর্শিদ সকাশে ব্যক্ত হয়েছে গানের কথামালায়। বিয়োগ ব্যথার জ্বালার মধ্যেও তাঁকে মুমিনের ধৈর্য প্রার্থনা করতে দেখা যায়। তিনি মাইজভাণ্ডারী গানের ভুবনে গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন হজরত সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান (ম.) মাওলা হুজুর মাইজভাণ্ডারীকে। অধ্যাপক রীনার উৎসর্গ পত্রের দীর্ঘ লেখাটি পড়ে মনে পড়ে যায় : ‘সুখে দুখে সমানভাবে যেজন তোমার স্মরণ লয়/ বনে কী মরণে রণে থাকে না তার কোন ভয়’…..[মাইজভাণ্ডারী গানের গীতিকার, একুশে পদকপ্রাপ্ত উপমহাদেশের বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীল।] তবে এই আধ্যাত্মিকতা, আল্লাহ রাসূল, অলি আওলিয়ার ঐশী প্রেম, খোদায়ী নিষ্কলুষ ভালোবাসা বুঝতে হলে প্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি – যা অধ্যাপক রীনা আকতারের চোখে অশ্রুর নদী বইয়ে দেয়। তাঁর হৃদয়কে সাগর জলে পরিপূর্ণ করে দেয়। তখন রীনার ঐশী অনুভবের সৃজনশীলতা ঝরনা হয়ে নামে হাতে কলমে কাগজে। এরূপ বিশ্বাস ও ভক্তির জোরে চেনা যায় ‘আল্লাহর জ্যোতির অধিকারী অলি আওলিয়া ও সাধারণ আলেম ওলামা জ্ঞানী গুণীরা এক বরাবর নন। সাগর নদী পুকুর জলে আকাশের চাঁদ সূর্যকে একরকম দেখালে ও প্রতিবিম্ব যথার্থ জ্যোতিহীন’। – [ শাহানশাহ জিয়াউল হক (ক.) মাইজভান্ডারী জীবনী। লেখক জামাল আহমদ সিকদার।]
চট্টগ্রামের অলি দরবেশ, মাইজভাণ্ডারী অলি আওলিয়া, মাইজভাণ্ডার সম্পৃক্ত অলিআল্লাহ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় যোগসূত্রিক তথ্য উপাত্ত এবং তাঁদের স্মরণে নিবেদিত বা রচিত সংগীত বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। অর্থাৎ যাঁদের স্মরণে সংগীত তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিত পাঠকের জানার পরিধি বৃদ্ধি করবে এবং নানা ধরনের পাঠকের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে। ‘মাইজভান্ডারী গানের ভূবনে’ : রীনা মন্দাকিনী গ্রন্থের সুদীর্ঘ প্রবেশক (ভূমিকা) লিখেছেন ড. সেলিম জাহাঙ্গীর। গবেষণা কর্মের নিরিখে তিনি উপস্থাপন করেছেন:- হিজরী সন, বঙ্গাব্দ ও খ্রিস্টাব্দের সন তারিখের সমন্বয় এবং মাইজভাণ্ডারী মহিলা গীতিকার কালানুক্রমিক তথ্য। ড. সেলিম জাহাঙ্গীরের ভাষায় : ‘মাইজভাণ্ডার বিষয়ে আমার সুদীর্ঘ তিন যুগ সময়কালের বহুমাত্রিক গবেষণার অভিজ্ঞতায় ঘুরে ফিরে বারংবার মনে হয়েছে স্থানুকাল-পাত্রের আলোকে সামগ্রিকভাবে অখণ্ড চিত্রের অভাবে মাইজভাণ্ডারী তরিকার বহুমাত্রিক চালচিত্র, মাইজভান্ডারী সাহিত্য ও গান, অনেকের কাছে পরিপূর্ণ মাত্রায় উপলব্ধি সম্ভব হয়ে উঠে না’।
অধ্যাপক রীনার বইতে চমৎকারভাবে যুক্ত করা হয়েছে মাইজভাণ্ডারী গানে ব্যবহৃত শব্দের টীকা ভাষ্য, ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণ। ড. সেলিম জাহাঙ্গীর সম্পাদিত বইটিতে আরও সংযোজন করা হয়েছে লেখক অধ্যাপক সৈয়দা রীনা আকতারের সংক্ষিপ্ত বংশলতিকা। লেখকের লেখালেখির শ্রম সাধনা ও অজস্র ত্যাগের ফলে এ মূল্যবান বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। এ গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখক অধ্যাপক গীতিকার রীনা অকৃপণ হস্তে ডালা নিবেদন করেছেন স্বামী পুত্র কন্যা আত্মীয়সহ সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাইজভাণ্ডারী একাডেমি, মাইজভাণ্ডারী মরমী গোষ্ঠী এবং ট্রাস্টের অনেক কর্মকর্তা সমীপে। আমি এ বইয়ের বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।
লেখক : অধ্যাপক, মহিলা কলেজ-চট্টগ্রাম; প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অস্থির সামাজিক অবস্থা
পরবর্তী নিবন্ধসচেতনতা ও ভ্যাকসিনেশন দিতে পারে ‘হেপাটাইটিস’ থেকে মুক্তি