নির্ভয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করে বাঙালি। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অধিকার অর্জিত হয়। এ আন্দোলন ‘ভাষা আন্দোলন’। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন করে। অবশ্য ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
‘অমর একুশের রক্ত-উজ্জ্বল দ্রোহী চেতনার অভিঘাতেই উৎসারিত ও বিকশিত হয় বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা, সংঘটিত হয় স্বাধিকার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ, অর্জিত হয় স্বাধীনসার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ’। তাই বাঙালি জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের নানা ঘটনা-প্রবাহ স্থান করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও কথাসাহিত্য রচিত হয় ভাষা আন্দোলন নিয়ে। নগরে এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলমান বইমেলায় আসা পাঠকদের দেখা গেছে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে রচিত এসব বই খুঁজতে।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য হতাশ হতে হচ্ছে পাঠককে। কারণ ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গ্রন্থের সংখ্যা অন্যান্য শাখার তুলনায় কম পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায়। এইক্ষেত্রে এ বছরের বইমেলাকে ঘিরে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একেবারে কম। তবে বিগত সময়ে প্রকাশিত হয়েছে এমন গ্রন্থ মেলায় পাওয়া যাচ্ছে। এসব বইয়ের প্রতিও পাঠকদের আগ্রহও ছিল উল্লেখ করার মত। এবার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ড. মাহবুবুল হকের ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’, ইলু ইলিয়াসের একুশের ‘পটভূমি ও সাহিত্যরূপ’, নির্মলেন্দু গুণের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’, মতিউর রহমানের ‘বিদ্রোহী বর্ণমালা’ ও ‘একুশের পটভূমি, একুশের স্মৃতি’ এমরান চৌধুরী সম্পাদিত ‘ছড়া-কবিতায় একুশ’। পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে রাদিন চৌধুরীর ‘ভাষা আন্দোলনের সহজ পাঠ’, সোহেল মল্লিক সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলনের নির্বাচিত ৫০ কিশোর গল্প, সুমাইয়া খানমের ‘ভাষা-আন্দোলন ও বাংলাদেশের কথাসাহিত্য’, ইসমাইল হোসেন বকুলের ‘রক্তের কারাগারে বন্দী ৮ই ফালগুন; ভাষা আন্দোলন ও রক্তঝরা একুশ’ ও ড. গুলশান আরার ‘ভাষা আন্দোলনের কথা’।
ড. মাহবুবুল হকের ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’ পাঠের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম লাভ করবে এক নতুন অভিজ্ঞতা। যা তাদের নতুনভাবে ভাষাপ্রীতি ও দেশবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে। তরুণ প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের জন্য গ্রন্থটি লেখা হয়েছে ইতিহাসের নিরিখে, সহজ ভাষায়। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের বড় মাইলফলক ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে শাসন ও শোষণের বেড়াজালে বাধার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। কেড়ে নিতে চেয়েছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। তার বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই ছিল ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনে রক্ত ঝরেছিল বাঙালির। তা সাহস জুগিয়েছিল অত্যাচার বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে। ভাষা দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি এগিয়ে গেছে স্বাধিকার আন্দোলনে। এগিয়ে গেছে মুক্তি সংগ্রামে। ভাষা আন্দোলনের সেই অমর কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে এই বই- ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’।
ফ্ল্যাপের তথ্য অনুযায়ী, ইলু ইলিয়াসের একুশের ‘পটভূমি ও সাহিত্যরূপ’ গবেষণা গ্রন্থটি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের উপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক গবেষণা-অভিসন্দর্ভ। যেখানে প্রথম উন্মোচিত হয়েছে বিস্তৃতকাল পরিসরে প্রসারিত একুশের পূর্ণাঙ্গ পটভূমি এবং একুশের সাহিত্যের সনাক্তযোগ্য মৌল বৈশিষ্ট্য এবং বিশ্লেষিত হয়েছে এর তাৎপর্য ও বিস্তারণ। অতএব বাঙালির সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস অন্বেষণ ও পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণে একুশের পটভূমি ও সাহিত্যরূপ হয়ে ওঠে অবশ্য পঠনীয়।
এমরান চৌধুরী সম্পাদিত ‘ছড়া-কবিতায় একুশ’ সংকলনে দেশের খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি তরুণ ও নবীন লেখকদের লেখা অন্তর্ভুক্ত আছে। ‘লেখাগুলোতে গুণগত মানের চেয়ে আবেগের প্রাবল্যে মা মাটির প্রতি ভালোবাসা ফুটে ওঠেছে পরম মমতায়। প্রাজ্ঞ পাঠক বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রন্থটি বিবেচনায় নিবেন বলে প্রত্যাশা এমরান চৌধুরীর।
মতিউর রহমান এর ‘একুশের পটভূমি, একুশের স্মৃতি’ সংকলনে বায়ান্নর একুশের সেই পটভূমি এবং তাৎপর্যকেই তুলে ধরা হয়েছে। ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, অনেকগুলো রচনায় ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ও সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বিশিষ্টজনের অন্তরঙ্গ বর্ণনা ও স্মৃতিচারণায় আন্দোলনকালীন দিনগুলির ঘটনাক্রম যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সময়ের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে সেই আন্দোলনের তাৎপর্য বিশ্লেষণের চেষ্টাও আছে বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধে।
এদিকে মেলায় আসা অন্যান্য নতুন বইগুলোর মধ্যে সঙ্গীতশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক কেশব জিপসীর ‘আমাদের গান’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, বোধের ও দায়িত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে সংগীতের আবহ পৌঁছে দিতেই রচনা করেছেন ‘আমাদের গান’। এ গ্রন্থ নিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষক শামসুদ্দীন শিশির বলেন, মানুষ কর্মেই বেঁচে থাকেন। কেশব জিপসীও সেই পথেই হাঁটছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্ম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। গানের যে আবেদন মানুষের মনের খোরাক যোগায় সেই আবেদনই গীত, সুর, ছন্দে তিনি বেঁধে নিয়েছেন।
আলোচনা সভা : গতকাল বইমেলার মঞ্চে অনুষ্ঠিত নৃগোষ্ঠী উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন বক্তব্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার। চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. গাজী গোলাম মাওলার সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুপ্রুই চৌধুরী ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী।