বিএম ডিপোয় বিভীষিকা, নিহত ৪৬

লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত ।। কন্টেনারে কী পণ্য তথ্য ছিল না ফায়ার সার্ভিসের কাছে ।। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও জ্বলছিল আগুন ।। কন্টেনার উড়ে গিয়ে পাশের গ্রামে অগ্নিকাণ্ড, আহত ৫শ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৬ জুন, ২০২২ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেনার ডিপোয় বিস্ফোরণে বিভীষিকাময় পরিবেশ। মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬ জনে উন্নীত হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে দিনভর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৮ জনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সীতাকুণ্ড ট্রাজেডিতে কাঁদছে চট্টগ্রাম, কাঁদছে দেশ। সহায়তার হাতও বাড়িয়েছে মানুষ।

জানা গেছে, বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এতে করে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত বিএম কন্টেনার ডিপোতে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৬ জন। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫শ মানুষ। এদের অনেকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শনিবার রাতে সংঘটিত বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলে ২ জন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ জন মারা যাওয়ার পর গতকাল ভোর থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার হতে থাকে। বিস্ফোরিত কন্টেনারের পাশ থেকে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে একসাথে উদ্ধার করা হয় ১১টি লাশ। এরপর থেমে থেমে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত রাতে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ জনে।

সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও গত রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আগুন জ্বলছিল। অনেকগুলো কন্টেনারের কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দূর থেকে পানি এবং ফোম দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনের ২৫টি ইউনিট কাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

গতকাল স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার রাত ৯টার দিকে বিএম কন্টেনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত হয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। কিন্তু কী ধরনের পণ্য বোঝাই কন্টেনারে আগুনে লেগেছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য ফায়ার সার্ভিসের কাছে ছিল না। বিএম কন্টেনার ডিপোর মালিকপক্ষের কেউ ফায়ার সার্ভিসকে কেমিক্যাল থাকার বিষয়টি জানাননি। এতে করে আগুন নেভানোর জন্য ব্যাপক হারে পানি ছিটানো হচ্ছিল। হাইড্রোজেন পারঅঙাইডে আগুন ও পানির যোগ হওয়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আগুন নেভানোর কাজে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাই প্রথমে উড়ে যান। কন্টেনারে আগুন লাগার পর অনেকে সেলফি তুলছিলেন, ছবি তুলছিলেন। বিস্ফোরণে যারা কন্টেনারের সাথে উড়ে যান তাদের অনেকের হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভয়াবহ বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। এতে আশেপাশের বাড়ি, অফিস ও মসজিদের জানালার গ্লাস ভেঙে যায়। কন্টেনার উড়ে গিয়ে পাশের মোল্লার পাড়া গ্রামে পড়ে। সেখানে অগ্নিকাণ্ডে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে যায়।

গতকাল দুপুরেও বিপুল সংখ্যক মানুষকে আহাজারি করতে দেখা গেছে। অনেকে স্বজনদের খুঁজতে ভিড় করেন ডিপোতে। পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ভিড় সমালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন গতকাল সকালে সাংবাদিকদের জানান, সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মোহাম্মদ মনির হোসেনের নেতৃত্বে ১৪ জনের একটি বিশেষজ্ঞ টিম উদ্ধার অভিযানে যোগ দিচ্ছেন। হ্যাজম্যাট (হ্যাজারডাস মেটারিয়াল) টিমে এসব সদস্য দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বলে জানান তিনি।

আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় এবং কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেনার থাকায় সুষ্ঠুভাবে উদ্ধারকাজ পরিচালনা সম্ভব হচ্ছিল না বলে উল্লেখ করে গতকাল ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগুন জ্বলছে। বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে। কেমিক্যালগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আরো অঘটন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগুন জ্বলছে এমন কন্টেনারগুলোর কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে না।

তারা বলেন, আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর থেকে ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে। আগুন পুরোপুরি নিভে না যাওয়া পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস কাজ করবে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

এদিকে গতকাল সকাল থেকে সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান, জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান, জেলা পুলিশ সুপার রশিদুল হক, সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন, সীতাকুণ্ডের ইউএনও মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সকালে ডিপোতে এসে বিভাগীয় কমিশনার মো আশরাফ উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা এবং প্রাথমিকভাবে আহতদের ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত মালিকপক্ষের কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। সেনাবাহিনীর দল এসেছে। গত রাতে আগুন লাগে, আপনারা দেখছেন, এখনো জ্বলছে। ডিপোতে ড্রেন আছে, সেই ড্রেন হয়ে খালে গেছে। সেই খাল আবার সাগরের সাথে সংযোগ আছে। রাসায়নিক যাতে সাগরে না যায় সে লক্ষ্যে উনারা কাজ করছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাজাহান সাংবাদিকদের বলেন, এই ডিপো যারা পরিচালনা করছেন তাদের আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তারা ফায়ার ব্রিগেডকে গাইড করতে পারবে কোথায় কোন কন্টেনার আছে। তাহলেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাদের আহ্বান করছি তারা যেন দ্রুত এখানে আসে।

তিনি বলেন, এখানে সব রপ্তানি পণ্য আসে। রপ্তানির মধ্যে রাসায়নিক থাকতে পারে। ফায়ার ব্রিগেড জানিয়েছে রাসায়নিকের ২৬টি কন্টেনার ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখলাম ইকুইপমেন্ট আছে, কিন্তু লোকজন নেই ডিপোর। এমনকি ট্রেইলারও সেখানে রয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমরা বন্দর থেকে একটি তদন্ত কমিটি করেছি। অনিয়ম ছিল কিনা তা তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান করে বলবে, নিরাপত্তায় বা অগ্নি নির্বাপণে কোনো ঘাটতি ছিল কিনা। বিস্ফোরণের কারণে আগুন ছড়িয়ে গেছে। শুরুতেই যদি সাহসিকতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে এত ব্যাপক হতো না।

ডিপোর এক কর্মকর্তা জানান, রাতের পালায় তাদের নিজস্ব ২শর মতো কর্মী ডিপোতে কাজ করেন। এর সঙ্গে আরো যুক্ত থাকেন কয়েকশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের চালক, সহকারী ও শ্রমিক। প্রায় ২৪ একর জমির ওপর ওই ডিপোটি অবস্থিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন
পরবর্তী নিবন্ধবেড়েছে রাজস্ব আয়, বাড়েনি জনবল ভোগান্তির অভিযোগ সেবাগ্রহীতাদের