বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অনুপম নেতৃত্ব

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন | শুক্রবার , ১৭ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

উদার গণতন্ত্রের চর্চা, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং উচ্চমাত্রার মানবতাবোধে সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, সাংগঠনিক দক্ষতা, সীমাহীন ত্যাগতিতিক্ষা, আপসহীন সংগ্রামী সংকল্পের কারণে তিনি হয়ে উঠেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তাঁর একক নেতৃত্বেই এদেশের জনগণ সর্বাত্নক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং জনযুদ্ধে পরিণত করে। জনসমুদ্রকে সামনে রেখে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিগবিজয়ী মহানায়ক, স্বাধীনতার মহান শিল্পী, বাঙালির মানসপটের মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ডাকে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য এদেশের মানুষ নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।

ভারতের প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকার, জীবনী গ্রন্থ ‘মাই ট্‌্রুথ’ (ভাষান্তর; স্কোয়াড্রন লীডার (অব.) মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম।) বইটিতে ইন্দিরা গান্ধীর নিজের ভাষায় তাঁর জীবন চিত্রায়িত হয়েছে। সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য উৎস থেকে গ্রন্থিত ‘মাই ট্‌্রুথ’ সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিরল একটি গ্রন্থ। এ বইতে অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে উপমহাদেশের অগ্রগণ্য রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে। জাতির পিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল, হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন: যতটা না তিনি শাসক ছিলেন, তারও চেয়ে বেশি ছিলেন জাতির পিতা’। ‘মাই ট্রুথ’ বইয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লিখেছেন– ‘‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই যুদ্ধ করেছিলো ‘তারা তখন যা কিছু করেছে, তা তাঁর নামে এবং তাঁর জন্যেই করেছে”।

১৯৭১ সালের ভয়াল ২৫ মার্চের কালরাত্রির মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১৮ মার্চ গান্ধী কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এবং তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। গান্ধীর বর্ণনা অনুযায়ী সেসময় ভারতে একটি অন্যরকম পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। কংগ্রেসে সংকট, তার ধারাবাহিকতায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ অসহিষ্ণু মনোভাব, নির্বাচনী প্রচারণা এবং এর ফলাফল সবকিছু মিলিয়ে দেশে একটি উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছিলো এবং তাদের উচ্চাশাকে প্রশমিত করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তা সত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে সে বিষয়ে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে পাকিস্তানীরা মুজিব (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)-কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার বদলে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে’। গান্ধী অনতিবিলম্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অভাবনীয় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিলো না। এটা যতোটা ধর্মীয় বিষয় তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিষয় ছিলো’। তিনি আরো লিখেন, ‘আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর থেকে দূরে ছিলাম। যদিও কিছু করার জন্য আমাদের ওপর চাপ ছিলো এবং কিছু মানুষ মনে করছিলেন যে আমাদের সৈন্য পাঠানো উচিত’।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফরে যান। সেখান থেকে পরে অক্টোবরে তিন সপ্তাহের রাষ্ট্রীয় সফরে ইউরোপিয়ান দেশগুলো সফর করেন। ‘তাদের দেশের জনগণকে একথা বলতে যে, যদি পাকিস্তানীদের ওপর তাদের কোন প্রভাব থাকে তাহলে সেই প্রভাব খাটিয়ে তাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে’। যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন ‘আমার মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলোনা যে বাংলাদেশীরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করবে। একবিন্দুও সন্দেহ ছিলো না’। শ্রীমতী গান্ধী আরো লিখেছেন যে, ভারত কখনোই এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী ছিলোনা। তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ছোট দেশগুলোকে উৎসাহিত করতাম। আমরা শ্রীলংকা, নেপাল, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং এরকম অনেক দেশকেই একই পরামর্শ দিতাম। যেন কেউই মনে না করে যে আমরা বড় আকৃতির কারণে অন্যদের জন্য চাপ সৃষ্টি করছি। কিন্তু আমরা মনে করেছি প্রত্যেক দেশকে সত্যিকার অর্থেই মুক্ত হওয়া উচিত, স্বাবলম্বি এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে স্বাধীন হওয়া উচিত। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, এই বিশ্ব পরস্পরনির্ভরতার বিশ্ব। তবে পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি কোন দেশের সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে নয়। অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেই সম্পর্কের অবনতি হয়। বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠে একাধিক ঘটনায়; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অধ্যাপক সমর গুহের নেতৃত্বে একটি দল ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দেখা করে বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার আহ্‌বান জানিয়েছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তাতে কর্ণপাত করেননি।

ইন্দিরা গান্ধীর পিতা জওহরলাল নেহেরু তার ‘Discovery of India গ্রন্থে লিখেছেন, ‘For the small national state is doomed. It may survive as a culturally autonomous area but not as an independent political Unit.’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবসানের পূর্ব মুহূর্তে লেখা এ বইয়ে নেহেরু মত দিয়েছিলেন, মানচিত্রের আকারে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। এ রকম ক্ষুদ্র রাষ্ট্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও পৃথিবীতে অনেক ক্ষুদ্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে এবং সেগুলো সগৌরবে টিকেও আছে। আবার এর উল্টো উদাহারণও অনেক সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্‌বানে তাঁর দেশের সৈন্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নিতে দ্রুত রাজি হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এক মুহূর্তেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আপনি যখনই চাইবেন তখনই বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।’ কথা রেখেছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক ইতিহাসে যেটা অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এখনো পৃথিবীর বহু দেশে মিত্র বাহিনী ঘাটি গেড়ে বসে আছে। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে জাতির পিতার ব্যক্তিত্বের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, তেজস্বিতা ও সম্মোহনী নেতৃত্বের কারণেই।

অনন্য ভাবমূর্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের এক প্রশ্নের জবাবে নেতৃত্বের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন– ‘সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ এক দিনে হঠাৎ করেই নেতা হতে পারেন না। এটা অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাঁকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, তিনি ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে। মানবতার জন্য আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তাঁর মধ্যে অবশ্যই নীতিআদর্শ থাকতে হবে। যদি কোনো নেতার এসব গুণ থাকে, তবে তিনি নেতা’। কালজয়ী মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক অনির্বাণ, অনিরুদ্ধ ব্যক্তিত্ব যাঁর অলোকসামান্য সম্মোহনী নেতৃত্বে সমগ্রবাংলার মানুষ একটি অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে যুথবদ্ধ হয়েছিলো।

সততা, আত্মজ্ঞান, মহানুভবতা, আত্মত্যাগ, উদারতা, মানুষের প্রতি মানবিক আচারআচরন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন ক্যারিশম্যাটিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেভাবে তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে একটি মঞ্চে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেভাবে পৃথিবীর অন্যকোনো নেতার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান মূল্যায়ন করে বিশিষ্ট লেখক জেমস জে. নোভাক লিখেছেন, ‘কঠোর পরিশ্রম বঙ্গবন্ধুর জীবনধারা গঠন করেছে। ক্লান্তিহীনভাবে তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শহর, নগর, গ্রাম গঞ্জে ভ্রমণ করেছেন। তিনি মানুষের সাথে মিশেছেন, কথা বলেছেন এবং তাদেরকে ভালবেসেছেন। জনগণ থেকে দূরে থাকা কালে তিনি তার অতি মানবীয় দৃষ্টিশক্তি দিয়ে প্রত্যেকটি ঘটনায় জনগণের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারতেন। তিনি জানতেন, জনগণ তাকে বিশ্বাস করে। কেননা তিনি তাদের কথা বুঝতে পারতেন’। একারণেই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটি অবিচ্ছেদ্য সত্তা, একে অন্যের পরিপূরক। এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্বের জন্য বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্থায়িত্ব আনতে হবে। তিনি কোন দল বা গোষ্ঠীর অর্জিত নন, দলীয় বা রাজনৈতিক স্বার্থের জন্যেও নন। বঙ্গবন্ধুকে ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্রই। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, ধারাবাহিক জীবন দর্শনই হলো বাঙালি জাতির মূল আত্মপরিচয়। জাতিকে এই আত্মপরিচয়েই বিকশিত হতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক আঙুলে এক বার্তা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : তোমার জন্মেই বাংলাদেশ, তুমি চিরন্তন