প্রিয় বাংলাদেশ : উন্নয়নের পথে – গৌরবের সাথে

ববি বড়ুয়া | শনিবার , ২৬ মার্চ, ২০২২ at ৭:২৯ পূর্বাহ্ণ

হঠাৎ মূল ফটকে ধুপধাপ সজোরে আঘাতের শব্দ। দরজা ভেঙে পড়ে এমন বিভৎস শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সদ্য বিবাহিত নীরা, তার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি আর ছোট আট ও বারো বছরের দেবর ননদের। দরজার ওপার থেকে শব্দ ভেসে আসছে, দরওয়াজা খুলো। দরওয়াজা খুলো’। আতঙ্কিত পরিবারের বয়স্ক সদস্য তার শ্বশুর কাঁপা হাতে দরজার কপাট খুলতেই পাক সেনার একজনের বুটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পরেন তিনি। এরই মধ্যে আরো কয়েকজন মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করে। এমন দৃশ্যে ভয়ে চিৎকার করে কান্নার শব্দ ছিটকে বেরুবার আগেই বুলেটের শব্দে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো তার দেবর ননদের কান্নার আওয়াজ। তাদের কয়েকজনে শক্ত করে ধরে রাখলো তার স্বামীর হাত। হাত ছাড়াতে চাওয়ার গোঙানি উপেক্ষা করেই নীরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো পাক সেনার জনা সাতেক তার শোবার ঘরে। নীরার ওপর চলতে থাকা বীভৎস অত্যাচারের মধ্যেই শুনতে পেলো আরো কয়েকটি গুলির শব্দ। এভাবে কতো সময় পেরিয়ে গেলো বা আর কি কি হলো তার কিছুই জানে না সে। যখন সম্বিত ফিরে এলো তখন ছিন্ন ভিন্ন শরীর কোনভাবে টেনে হেঁচড়ে সামনের ঘরের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলে চোখে পড়লো মাত্র দুদিন আগে বিয়ে হওয়া তার স্বামীর রক্তাক্ত দেহ। কোনভাবে কাছে এসে তার রক্তাক্ত বুকে হাত রাখতেই তার মেহেদী রাঙা হাত আর রক্তের রং একাকার হয়ে গেছে। হঠাৎ হাসতে হাসতে বললো, দেখো কি সুন্দর রঙ জমেছে আমার মেহেদীর!
স্বাধীনতা বিরোধী দোসর আলবদর আলসামস বাহিনীর দেখিয়ে দেয়া চিহ্নিত বাড়িগুলোতে সেদিনের সেই ভয়াল সর্বনাশা কালো রাতে শতশত পরিবারে পিতা-মাতা হারিয়েছে তাঁর সন্তান, স্ত্রী তার স্বামী, বোন তার ভাই কিংবা কোন কোন পরিবারে কাউকে হারাবার কেউ থাকলোই না। শুধু রক্তের স্রোত বলে দিচ্ছিল এইতো অল্প কিছুক্ষণ আগেও এই ঘরে মানুষ বসবাস করতো।
এভাবেই ৭১ এর ২৫ মার্চ রচনা হয়েছে বাংলার ইতিহাসে ‘ অপারেশন সার্চ লাইট ‘ নামের কালো অধ্যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিন এই বাংলার মানুষ দেখেছিল এক অন্যরকম নব উদিত রক্তিম সূর্য। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্য। সেদিনই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। সেদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চের মধ্য রাতের পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর কাছে মূল লক্ষ্য ছিল পুরোনো পাকিস্তানি শাসন-শোষণের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো ভেঙে ফেলা এবং দুঃখী ও মেহনতি মানুষের রাজনীতি, গণমানুষের স্বার্থে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, নিজ দেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন। তাই বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শোষকের গণতন্ত্র।’
১৯৭২ সালের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ নেতারা দলের এক নতুন ভাবাদর্শ প্রচার করতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট এই তত্ত্বের নাম হয় মুজিববাদ। দেশব্যাপী মুজিববাদের এই তত্ত্বের লক্ষ্য হলো বাঙালি জাতিকে সুসংহত করা।
আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু কন্যাও কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। সমগ্র দেশের মানুষের পাহারায় কাটাচ্ছেন বিনিদ্র রাত আর স্বপ্ন বাস্তবায়নে পার করছেন দিন। তাঁর চোখ জুড়ে পিতার এঁকে যাওয়া স্বপ্ন।
আর তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টানা তের বছর ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এ সুদীর্ঘ সময়পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনীতি ও মানব উন্নয়নসহ নানা সূচকসহ এগিয়েছে দেশ নানা দিকেই। কিন্তু মানবাধিকার ইস্যু ও মূল্যস্ফীতির টানপোড়নে নাভিশ্বাস দেশের মানুষ । মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাড়ছে দ্রব্যের দাম ।দিনদিন হাতের নাগালের বাইরে যাচ্ছে দ্রব্যের ক্রয়ক্ষমতা। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির লাইন। যা একসময় নিম্ম বিত্তের জন্য বরাদ্দ ছিল এখন তা মধ্যবিত্তেরও আগ্রহের কারণ। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার অভাব, অতি-আমলা নির্ভরশীলতা, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন নেতাদের দ্বন্দ্ব, আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়মুখী প্রবণতা এবং এই প্রবণতার কারণে কিছু মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে ধীর হচ্ছে গতি। দুর্নীতি দমন, সামপ্রদায়িকতার মূলোচ্ছেদ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় হাসিনা-সরকার তাদের সব আন্তরিকতা সত্ত্বেও সফল হতে পারছেনা। শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের ফসল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রাণপাত করছেন।
বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ঔপনিবেশিক আমলের আমলা-শাসনের বদলে নির্বাচিত জেলা গভর্নর দ্বারা দেশ পরিচালনার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। দেশ শাসন ও গণতান্ত্রিক শাসন-কাঠামো পুনরুদ্ধারে শেখ হাসিনার সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তার তিন দফার শাসনামলেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। বরং তা আরও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকও তাই বলেছেন, বাংলাদেশের বিপুল অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে ।কিন্তু তা যে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণকে প্রণোদিত ও সেই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারছে না, তার মূল কারণ ব্যাপক দুর্নীতি এবং আরও দুর্ভাগ্যের কথা এই দুর্নীতি প্রশাসনের সর্বত্র বিরাজ করছে।
মূলত কিছু সমস্যা থাকলেও বলা যায়, উন্নয়নের ধারায় সঠিক পথেই আছে সরকার। এ সরকারের আমলে স্বাধীনতার ৫০ বছর ও মুজিববর্ষে স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণ ঘটেছে উন্নয়নশীল দেশে। বাস্তবে রূপ নিয়েছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেল। বিদ্যুতে ও খাদ্যে এসেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। রোহিঙ্গা সমস্যা, করোনা মহামারি মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ দেখিয়েছে অনুকরণীয় সাফল্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের যে ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সে পথ ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিতর্ক থাকলেও মাথাপিছু আয় অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। মানবসম্পদের দিক থেকেও বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০-২১ সালের হিসাবে যা দাঁড়িয়েছে ৩৮.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপির আকার ৪১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। রেমিটেন্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় অবদান রেখে চলেছে। গত ৫০ বছরে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক সময় যে দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত ছিল, এখন বলা হচ্ছে ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে দেশটি এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে। সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বাংলাদেশ এখন তার নিজস্ব রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঋণও দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু চারনীতি ও বাংলাদেশের চার স্তম্ভের সঠিক পরিচর্চার মধ্য দিয়েই আশা করা যায়, একদিন না একদিন বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত দেশে পরিণত হবে এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বাংলাদেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যত অত্যন্ত উজ্জ্বল।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা স্বাধীনতা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে