প্রবাহ

ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি গাজিয়ান টেপ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

গাজিয়ান টেপ তুরস্কের পূর্বাঞ্চলের দিকে পাহাড়পর্বত নিয়ে। গাজিয়ান টেপ তুরস্কের প্রাচীন ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ শহর। গত ৬ ফেব্রুয়ারী সোমবার ভোরে রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার প্রবল ভূমিকম্পে গাজিয়ান টেপসহ তুরস্কসিরিয়া সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিস্তীর্ণ এলাকার শহরগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।

প্রবল ভূমিকম্পের পর থেকে টিভিতে বারে বারে তুরস্কের গাজিয়ান টেপের কথা বলা হচ্ছিল। তুরস্কের যে এলাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানে তৎমধ্যে গাজিয়ান টেপ এ ঐতিহাসিক শহর।

২০০৮ সালে ইরান হয়ে তুরস্ক সফরকালে এ গাজিয়ান টেপ ৩ রাত অবস্থান করা হয়। ফলে টিভিতে এবং পর দিন সংবাদপত্রে গাজিয়ান টেপের কথা আসায় আমারও গাজিয়ান টেপ কেন্দ্রিক নানা স্মৃতি মনে ভাসছে।

শত বছরের ইতিহাসে তুরস্কে এমন প্রবল ভূমিকম্প আর হয়নি। বাংলাদেশ থেকে বিমান বাহিনীর বিমানে উদ্ধারকর্মীদের গমন বারে বারে দেখতে ভাল লাগছিল। তুরস্ক আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ। সে দেশের সরকার জনগণ আমাদেরকে ভালবাসে। তুরস্কের ফাস্ট লেডি কষ্ট স্বীকার করে রোহিঙ্গা শরণার্থী দেখতে এসেছিলেন।

গত ৬ ফেব্রুয়ারী ভোরে তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তে আঘাত হানা প্রবল ভূমিকম্প অনেকটা মূলকে শাম এরিয়ার মধ্যে। সিরিয়াকে শাম বলে, মূলক মানে দেশ। বর্তমান সিরিয়া মূল মূলকে শামের একটি অংশ মাত্র। বর্তমান ফিলিস্তিন (জবরদখলী ইসরাইল), লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান মূলকে শামের অন্তর্ভুক্ত। তুরস্কের সিরিয়া সীমান্তে, সৌদি আরবের জর্ডান সীমান্তে, ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের কিছু কিছু অংশ মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত। হযরত মূসা (.)’র নানান স্মৃতি বিজড়িত মিশরের সিনায় উপদ্বীপ মূলকে শামের অন্তর্ভুক্ত কিনা তা নিয়ে রয়েছে মতভেদ।

বিশ্বের প্রাচীনকাল থেকে মূলকে শাম সমৃদ্ধ এরিয়ায় হাজার হাজার নবী রাসূলের আগমন ঘটে এখানে। এ অঞ্চল নিয়ে রোমান ও পারস্য সম্রাটের মধ্যে বারে বারে যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস রয়েছে। পবিত্র মক্কাবাসীগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঘনঘন এখানে আসতেন। আমাদের নবী পাক (.) নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে এখানে একাধিক বার এসেছেন। আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (.) আমলে মূলকে শাম ইসলামের ছায়াতলে আসে। বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক প্রাচীন শহর হলেও মূল মূলকে শামের প্রাণকেন্দ্র হল জেরুজালেম।

এ বিশাল মূলকে শাম ৪/৫ শত বছর তুর্কি সুলতানেরা শাসন করে গেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সাথে পরাজয়ে ফ্রান্সের সহযোগিতায় ব্রিটিশের নেতৃত্বে বিশাল মূলকে শাম খন্ড খন্ড হয়ে যায়। যা আজকের বাস্তবতা।

জেরুজালেম ভিত্তিক মূলকে শাম এবং পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা ভিত্তিক হেজাজ ৪/৫ শত বছর তুর্কি সুলতানগণের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের মানুষের মনে তুরস্কের প্রতি আলাদা একটা প্রেম, ভালবাসা প্রায় সবকিছুতেই সহমর্মিতা প্রকাশ করে আসছে, যা ইতিহাস সাক্ষী। শুধু তাই নয়, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় (মিশর তুরস্কের অধীনে ) নিজস্ব শীপ ইয়ার্ড থাকার পরেও বিশ্বের অন্যান্য স্থানের গুরুত্ব না দিয়ে চট্টগ্রাম মোহরার দিকে অবস্থিত চট্টগ্রাম শীপ ইয়ার্ড থেকে জাহাজ কিনে নিয়ে যেত। শত শত বছরের তুরস্কের জনগণের সাথে আমাদের দেশের আজও সুসম্পর্ক অটুক রয়েছে।

এ মূলকে শামের তুরস্ক অংশে ভূমিকম্প প্রবল আঘাত হানে। এতে উভয় দেশের হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করছে। এতে বাংলাদেশ উদ্ধারকারী দল উদ্ধার অভিযানে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। একজন জীবিতসহ একাধিক মৃতদেহ উদ্ধার করে।

শীতকালে তুরস্কের প্রায় এরিয়ার তুষার পড়ে। প্রবল ভূমিকম্পও আঘাত হানে শীতকালে। টিভির মাধ্যমে বারে বারে জানতে পারছি ঠান্ডা, বৃষ্টি তথা প্রতিকূল আবহাওয়ায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

আমার ২০০৮ সালের প্রথম বার ১১ জুন ইরানের রাজধানী তেহরান হয়ে তার্কিশ এয়ারে ইস্তাম্বুল পৌঁছি। ইস্তাম্বুল থেকে সড়কপথে আল্লামা রুমির শহর কোনিয়া আসা হয়। কোনিয়া থেকে সড়কপথে আসি সাগরতীরে ও আসহাবে কাফের শহর মার্সিনে। এখান থেকে আবারও সড়কপথে আসা হয় গাজিয়ান টেপ । গাজিয়ান টেপ শহরটি ইস্তাম্বুল ও আংকারার মত বিশাল না হলেও ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ শহর। এখানে রয়েছে প্রাচীনকালের নানা স্মৃতিচিহ্ন। সাথে তুর্কি সুলতানগণের নানান অবকাঠামো দাড়িয়ে আছে। গাজিয়ান টেপকে শিল্প নগরী বলা হয়। এখানে ব্যাপক শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠে। সহযাত্রী এমদাদ উল্লাহর পাশাপাশি নরসিংদীর বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন গাজিয়ান টেপ আসার উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক কাজকর্ম। তিনি তুরস্ক ও ইরানে ব্যাপকভাবে পাট রপ্তানি করেন। (সাখাওয়াত সাহেব ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্তেকাল করেন) আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য মূলকে শামের প্রাচীন জনপদে গমন করতে। তৎমধ্যে হযরত ইব্রাহীম (.) জন্মস্থান এবং একাধিক নবী রাসূলের যেয়ারত।

গাজিয়ান টেপ থেকে ২ শত কি.মি পূর্বে সিরিয়া সীমান্তের অনেকটা নিকটে হযরত ইব্রাহীম (.)’র জন্মস্থান উর্ফা। তিনি এখানে যৌবনের প্রারম্ভ পর্যন্ত কাটান। নমরুদ বাদশাহ এর সাথে নানান ঘটনা এখানেই হয়। এখান থেকে হযরত ইব্রাহীম (.) ফিলিস্তিনে হিযরত করেন। গাজিয়ান টেপ এর অন্যদিকে (তাও সিরিয়া সীমান্তের কয়েক কি.মি আগে) একাধিক নবী রাসূলের কবর রয়েছে।

৩ রাত গাজিয়ান টেপ অবস্থান কালে শহর ঘুরেফিরে দেখা হয়। গাজিয়ান টেপ থেকে তার্কিশ এয়ারে ইস্তাম্বুল আসা হয়। প্রথম জুমা ইস্তাম্বুল ব্লু মসজিদে পড়লেও দ্বিতীয় জুমা এ শহরের বিশাল মসজিদে পড়া হয়। ইস্তাম্বুলের মত এখানকার জুমায় পুরুষের সাথে সাথে নারীদের উপস্থিতি ব্যাপক ছিল। পাহাড়পর্বত এরিয়ার ভিতর এ শহরের অবস্থান। অবশ্য সমস্ত তুরস্ক পাহাড়পর্বত এরিয়া নিয়ে বলা যাবে। ইস্তাম্বুল থেকে আংকারা হয়ে কোনিয়া। কোনিয়া থেকে মার্সিন এবং গাজিয়ান টেপ আসার পথে সমগ্র সড়কপথে পাহাড় আর পাহাড়, বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি চোখে পড়েনি।

গাজিয়ান টেপ শহর যেমনি পাহাড়ী এরিয়া নিয়ে তেমনি শহরের চতুর্দিকে দৃষ্টি দিলে পাহাড় আর পাহাড়। শহর থেকে শহর যে দিকে দৃষ্টি যায় আমাদের দেশের মত পরিত্যক্ত পাহাড়পর্বত নয়। নানান ফল ও বিভিন্ন বাগানে ভরপুর। বিশ্বে বিভিন্ন প্রকারের ফল ও বাদামের জন্য তুরস্ক বিখ্যাত।

গাজিয়ান টেপ থেকে আর ২ শত কি.মি পূর্বে হযরত ইব্রাহীম (.)’র জন্মস্থান উর্ফায় যাওয়াআসাকালে পাহাড়ী অঞ্চল অতিক্রম করে যাওয়া হয়েছিল। উর্ফায় নমরুদ বাদশাহ এর প্রাসাদও পাহাড়ের উপর ছিল।

তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। লাখ লাখ মানুষ আহত ও এর মধ্যে অসংখ্য ক্ষতিগ্রস্ত কোটিপতি ,ঘরবাড়ী ফ্ল্যাটের মালিক মুহূর্তের মধ্যেই নিঃস্ব হয়ে যায়।

এক ব্যক্তি যিনি অনেক বাড়ী সম্পদের মালিক তিনি হাতে সাহায্য প্রাপ্ত কয়েকটি রুটি নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে দাড়িয়ে আছেন দৃশ্য দেখতে পাই। অর্থাৎ যিনি ধন সম্পদ বাড়ী ঘরের মালিক তিনি মাত্র ১ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেলেন; শরীর বাদে কিছুই নেই। ইহা আল্লাহপাকের মহিমা।

এই ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করছি। আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিন থেকে ফিরতে দমকা হাওয়ার কবলে জাহাজ