প্রতীকের স্বপ্ন

জোনাকী দত্ত | বুধবার , ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

দুই ভাই ড্রইংরুমে ক্রিকেট খেলছে। হঠাৎ ধপাস করে শব্দ হল। মা রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসল। উৎকণ্ঠা নিয়ে মা বলল, কি রে কি হল? দুই ভাই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মা দেখল, সামনে কাচ ভাঙ্গা পড়ে আছে। মাথা তুলে দেখল, আলমারির আয়নাটাই ওরা ভেঙে ফেলেছে। মা শুভকে জিজ্ঞেস করল, কি রে কে ভেঙ্গেছে? শুভ ভয়ে ভয়ে বলল, আমি বল করছি প্রতীক ব্যাট করেছে।প্রতীক তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,সরি মা, খেলতে গিয়েই ভেঙ্গে গেল। মা অনেকক্ষণ ওদেরকে বকাঝকা করে চলে গেল।দু’তিন দিন খেলা বন্ধ। ওরা মন খারাপ করে বসে থাকে। এটা দেখে মা আবার খেলার অনুমতি দিল। তবে শর্ত ছিল এবার কিছু ভাঙলে আর কোনদিন খেলতে দেয়া হবে না। ওরা এই শর্তে রাজি হল।
প্রতীক ১ম শ্রেণিতে পড়ে আর শুভ ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। দুই ভাই নিয়মিত স্কুলে যায়। ক্রিকেটের মত ওদের আর একটা নেশা হল গল্প বই পড়া। ঘুমানোর সময়, খাওয়ার সময় ওদের নিয়মিত বই পড়তেই হবে। প্রথম আলো পত্রিকার ‘রস আলো’ ওদের খুব প্রিয়। ওরা ওগুলো জমিয়ে রাখে। পরে আবার সবগুলো পড়ে। বাংলাদেশের খেলা যখন টিভিতে দেখায় তখন ওরা সবকিছু ছেড়ে খেলা দেখে। সাকিব আল হাসানকে প্রতীক খুব পছন্দ করে।
কিছুদিন পর বন্ধুদের সাথে বাসায় ড্রয়িং রুমে প্রতীক ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ওদের ছোটবেলার ছবি ভেঙে ফেলল।মা বন্ধুদের সামনে কিছুই বলতে পারেনি। পরে অবশ্য অনেক বকাঝকা করেছে।দু’এক বছর পর আবার ড্রয়িং রুমে ক্রিকেট খেলা। এবার অবশ্য ওদের বাবা-মা ঘরে ছিল না। পাশের বাসার
ছেলেসহ ওরা ক্রিকেট খেলার সময় ফ্রিজে যে চাবি লাগানো ছিল তার অর্ধেক ভেঙ্গে বাইরে পড়ে আছে আর অর্ধেক ভিতরে রয়ে গেছে। মা বাইরে থেকে আসার পর যখন ঘটনাটা জানল তখন বাবাকে বলল, তোমাকে বারবার মানা করেছিলাম, ড্রয়িং রুমে খেলার জায়গা রাখিও না। তুমি শোন নাই। এবার সামলাও। বাবা প্রতীক আর মুক্তকে অনেক বকা দিল। বলল, আজ থেকে এখানে খেলা বন্ধ। আমি আর কোন অভিযোগ যাতে না শুনি।
এরপর প্রতীক যখন ৫ম শ্রেণিতে উঠল ক্রিকেট শেখার জন্য পাগলামি শুরু করে দিল। মা একদিন বলল, ঠিক আছে তোকে ক্রিকেট শেখাব। তবে শর্ত হল ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেতে হবে। প্রতীক বলল, বৃত্তি পাওয়া কি এতই সহজ? দাদা মাঠে খেলতে গেলে ও আমাকে সাথে নিয়ে যায়না। শুধু ঘরে একটু খেলতে পারি। আমি ক্রিকেটার হতে চাই মা। এটাই আমার স্বপ্ন।
ঠিক আছে, আমি তো বলেছি।এই খেলার জন্য ঘরের কত কিছু ভেঙেছিস মনে পড়ে? তোদের জন্য কাচের কোন ছবি টাঙাতে পারি না। একবার কাচ ভাঙলি, আর একবার বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘরে খেলতে গিয়ে তোদের ছোট বেলার ছবি ভেঙে ফেললি। তারপর কিছুদিন আগে ফ্রিজে চাবি লাগানো ছিল। পাশের বাসার ছেলে এসে একসাথে খেলছিস। সেই চাবি ভেঙে অর্ধেক ভিতরে রয়ে গেল আর অর্ধেক বাইরে পড়ে রইলো। তারপরও বলছি আমি তোকে ক্রিকেট খেলতে দিব। কিন্তু আগে লেখাপড়া।
প্রতীক ৫ম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেল। কয়েক মাস পর বৃত্তির রেজাল্ট বের হল। সেই দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি। প্রতীক টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেল। ওর মা বাবা, স্বজন, স্কুলের শিক্ষকরা খুব খুশি হল। স্কুলে ও এবার ১ম হয়েছে। এখন শুধু ওর স্বপ্ন পূরণের পালা। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় ক্রিকেট শেখা হচ্ছে না। তবে মাঠে প্রতীক শুক্রবারে খেলতে যায়। স্কুল বন্ধ থাকলে মাঝে মাঝে প্রায় প্রতিদিন ও যাওয়া হয়।
সেদিন ওদের বাসায় এক পরিচিত আসল। প্রতীকের ক্রিকেটের কথা বলায় উনি বললেন, ক্রিকেট শিখতে দিলে আবার লেখাপড়াটা বরবাদ হয়ে যাবে।ও তো লেখাপড়ায় ভালো।ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বৃত্তিও পেয়েছে। ওর মা বলল,হ্যাঁ, সেজন্য তো ভয় হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি ওকে যে কথা দিয়েছি তা রেখেছি। শুধু ই কথাটি রাখতে পারছি না। লোকটি বলল, কি করবে বল, দেশের পরিস্থিতি ও ভালো না। তোমাদের বাসা থেকে স্টেডিয়াম অনেক দূরে। তুমি স্কুলে চাকরি কর। ওকে কে নিয়ে যাবে। মা বলল, কাউকে যদি সঙ্গী পেতাম। অনেককে বলেছিলাম। কেউ রাজি হচ্ছে না। ছেলে তো ক্রিকেটের জন্য পাগল।লোকটি বলল, ওকে বোঝাও। শুনেছি ও বিজ্ঞান মেলা,ড্রইং, আরো নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে প্রতিবছর বিভিন্ন পুরস্কার পায়। ওকে ওগুলোতে উৎসাহ দাও। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু ও ক্রিকেট ছাড়া কিছু বোঝে না। তেমন খারাপ ও খেলে না। আচ্ছা দেখি কি করতে পারি।
মায়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না। কেউ বলছে শেখালে ভালো হবে, কেউ নানারকম সমস্যার কথা বলছে। কি করবে তাই ভাবছে।প্রতীক আর শুভ মাঝে মাঝে ঘরে ওদের ছোটবেলার যে খেলনা ছিল ওগুলোকে খেলোয়াড় বানিয়ে দু’ভাই দুই পক্ষ নিয়ে ক্রিকেট খেলে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খেলোয়াড়দের নাম দিয়ে খেলনাগুলোকে দিয়ে ব্যাট ও বল করায়। এগুলো আবার খাতায় লিখে রাখে কখন কোন দেশ জেতে হারে। ওরা নিজেরা ও যখন বাসায় ক্রিকেট খেলে তখনও খাতায় লিখে রাখে।ওর মা অনেক চেষ্টা করেও কাউকে প্রতীকের সঙ্গী পেল না যাতে একসাথে গিয়ে ক্রিকেট খেলতে পারে। ওকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য মা বলে, শুধু ক্রিকেট শিখাটাই কি আসল? তুই তো মাঠে গিয়ে অনুশীলন করতে পারিস। তোকে ব্যাট,বল,প্যাড,হ্যালমেট সব কিনে দেওয়া হয়েছে। প্রতীক বলল, শুধু মাঠে খেললে হবে? আমরা অনেক কিছুই জানি না।আর খেলা শিখলে বিভিন্ন টিমে খেলতে পারব। এখানে তো তেমন টিম নেই।
মা বলল, তোর বন্ধুদের নিয়ে টিম করতে পারিস না?
প্রতীক বলল,ওরা কি টিম করবে?ওরা শুধু টেবিল টেনিস,বাস্কেট বল,আর ফুটবল নিয়ে ব্যসত।আমি নিজেও এখন টেবিল টেনিস আর ফুটবল খেলি। মা বলল,মন খারাপ করিস না,কপালে থাকলে একদিন ঠিকই সুযোগ পাবি।লেখাপড়াটা আগে ভালোভাবে কর। প্রতীক বলল,যারা ক্রিকেটার হয়েছে
তারা তো লেখাপড়াটা মোটামুটি করেছে।ওরা দেখ ক্রিকেট ভালো করে শিখে এখন ভালো ক্রিকেটার হয়েছে।মা বলল,সবার ভাগ্য তো আর একরকম না।সবাই জাতীয় দলে সুযোগ ও পায় না। প্রতীক বলল,চেষ্টা তো করতে হবে।মা বলল, ঠিক আছে বাবা, তোর সাথে কথায় পারব না।কোন সঙ্গী পাস
কিনা দেখ তাহলে শিখতে পারবি।প্রতীক মুখ গোমড়া করে বলল,যাও যাও সঙ্গীও পাওয়া যাবে না,খেলা শেখা ও হবে না। আমি এখন মাঠে যাচ্ছি খেলতে। মা বলল,ঠিক আছে যা,বেশি দেরি করিস না।
এইভাবে দিন যায়, মাস যায়,বছর ও পেরিয়ে যায় প্রতীকের আর ক্রিকেট শেখা হয় না।ও এখন মাঝে মাঝে বন্ধুদের টিমে ম্যাচ নিয়ে বিভিন্ন স্কুলের সাথে ফুটবল খেলে।ডিবেট অনুশীলন করে।আর বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করে।তারপর ও ক্রিকেটের তৃষ্ণা যায় না।সুযোগ পেলেই কারো না কারো
সাথে ক্রিকেট খেলতে মাঠে ছুটে যায়। প্রতীক মনে মনে ভাবে,আমি কি কোনদিন বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটার হতে পারব? জানি না ভাগ্যে
কি আছে। ক্রিকেট খেলাটা আমার স্বপ্নই থেকে যাবে। কিন্তু আমি যে একজন ভালো ক্রিকেটার হতে চাই। আমি ও চাই একজন সাকিব আল হাসান হতে।আমার স্বপ্নটা কি খুব কঠিন?

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্ন
পরবর্তী নিবন্ধকি ছু জা না কি ছু অ জা না