(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
একটি গেটে এসে থামলো আমাদের বাস। ফরবিডেন সিটির গেট। ফরবিডেন সিটি–সহজ বাংলায় বললে নিষিদ্ধ শহর। কিন্তু নিষিদ্ধ শহরটি আজ আর নিষিদ্ধ নেই, পুরোপুরি উন্মুক্ত। নির্দিষ্ট অংকের কড়ি ফেলে ধনী গরীব দেশি বিদেশী যে কোন মানুষ এই নিষিদ্ধ শহরের অলিতে গলিতে চক্কর মারতে পারে। ইচ্ছে মতো ঘুরতে পারে, ঘরে বাইরে বারান্দায় সর্বত্র চষে বেড়াতে পারে। গেট পার হওয়ার পর পুরো এলাকাটিতে আর বাধা দেয়ার কেউ থাকে না। অথচ একদিন এই ফরবিডেন সিটিতে বিনা অনুমতিতে সাপের জিহ্বাও প্রবেশ করতে পারতো না!
ফরবিডেন সিটি কি? ও হ্যাঁ, তাই তো। আসল কথাইতো বলা হয়নি। ফরবিডেন সিটি ছিল চীনের সম্রাটদের বাসস্থান, রাজপ্রাসাদ। এটিকে প্যালেস কমপ্লেক্স নামেও ডাকা হয়। তবে এই প্রাসাদ কোন সাধারণ প্রাসাদ নয়, এখনকার রাজপ্রাসাদগুলোর মতোও নয়, একেবারে অন্যরকম। পাঁচশ‘ বছর ধরে চীনের ক্ষমতাসীন সম্রাটেরা ফরবিডেন সিটির এসব ভবনে বসবাস করেছেন। এটিই ছিল বিশাল চীনের কয়েকশ’ বছরের প্রশাসনিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্র।
বর্তমানে এটির সাথে আর রাজা কিংবা সম্রাটদের কোন সম্পর্ক নেই। এটি পুরোপুরিই ট্যুরিস্ট স্পট। চীনের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর মধ্যে ফরবিডেন সিটি অত্যন্ত ব্যস্ততম, গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং শহরে বেড়াতে আসা এমন একজন লোকও নাকি পাওয়া যাবে না যিনি ফরবিডেন সিটি ঘুরে দেখেননি। এতে করে নিষিদ্ধ শহরে সকাল থেকে মানুষ গিজগিজ করে, আমরাও সেই ভিড়ে সামিল হওয়ার জন্য হাজির হয়েছি।
ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশের টিকেট লাইন ধরে কিনতে হয়। গেটের পাশেই কাউন্টার রয়েছে। তবে আমাদের টিকেট ট্যুর অপারেটর আগে ভাগে করে রেখেছিলেন। ফলে আমাদেরকে আর লাইন ধরে টিকেট করার ঝক্কি সামলাতে হলো না। বিদেশীদের জন্য প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পটেই টিকেটের বাড়তি দর রাখে। এখানে কি অবস্থা কে জানে! বাস থেকে নামার পর কিছুটা পায়ে হেঁটে আমরা ফরবিডেন সিটির মূল চত্বরে ঢুকলাম। প্রথম দেখাতেই কেমন যেন চমকে উঠলাম। এত আয়োজন ভিতরে? সুউচ্চ দেয়াল ঘেরা ফরবিডেন সিটির শুধু ভিতরেই নয়, প্রবেশের সময় খেয়াল করলাম যে গেটেও বেশ নান্দনিকতা রয়েছে।
চীনের ইউয়ান রাজবংশের সময় ফরবিডেন সিটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও এর মূল স্থাপনাগুলো গড়ে ওঠে মিং ও ছিং রাজবংশের শাসনকালে। ১৫ বছর ধরে দশ লাখেরও বেশি শ্রমিক ফরবিডেন সিটি নির্মাণের কাজ করেন। দক্ষিণ পশ্চিম চীনের গহীন অরণ্য থেকে আনা হয় মহামূল্যবান ফোবে চেনান কাঠ। পাহাড় থেকে বয়ে আনা হয় সাদা মার্বেল পাথরের বিশাল সব খন্ড। যা দিয়ে সাজানো হয় সম্রাট এবং তার স্ত্রী সন্তানদের নানা কক্ষ। ক্ষমতাধর নানা জনের কক্ষ এবং অফিসও সাজানো হয় দারুণভাবে। পাথর কেটে কুটে তৈরি করা হয় অসাধারণ সব ভাস্কর্য।
প্রাসাদের কক্ষগুলোর মেঝে তৈরি করা হয় সোনালি ইট দিয়ে। বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্থানগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃত অপরূপ এই স্থাপনাকে ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত করে। একই সাথে দুনিয়ায় কাঠের কাজের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ বলেও ঘোষণা করে।
ফরবিডেন সিটিতে প্রায় ৫০০ বছর ধরে চীনের সম্রাটদের বসবাস ছিল। মিং রাজবংশের ১৪ জন ও ছিং রাজবংশের ১০ জন সম্রাট ফরবিডেন সিটিতে বসবাস করে গেছেন। শুধু কী বসবাস ? প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে–শাদী, নৌ–বিহার, ভর পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় স্নান, সম্রাটদের অভিষেক, দরবার কিংবা বিচার সবই হতো এই নিষিদ্ধ নগরীতে। সম্রাট এবং তাদের পরিবারের আনুষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল এই নগরী। এখানে গেট অফ গ্রেট হারমোনি, হল অফ গ্রেট হারমোনি, দ্যা প্যালেস অফ হেভেনলি, দ্যা হল অফ মেন্টাল কাল্টিভেশন, দ্যা গেট অফ ডিভাইন মাইট, হল অফ প্রিজারভিং হারমোনি, দ্যা হল অফ লিটারারি গ্লোরিসহ নানা নামের অনেকগুলো ভবন রয়েছে।
শহরের বুকে ১৮০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা অনন্য এই স্থানটিতে ৯০ টিরও বেশী প্রাসাদ, ১৮০ টির মতো চত্বর ও ৮ হাজার ৭২৮ টির মতো রুম রয়েছে। ফরবিডেন সিটি মুলতঃ দুই ভাগে বিভক্ত। দক্ষিণের ভাগ বাইরের দিকের অংশ। এখানের সম্রাট বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজ করার সাথে সাথে জনসম্মুখে বিচার সালিশ করতেন। আর উত্তরের দিকের অংশ হল অভ্যন্তরীণ কোর্ট, এখানে সম্রাট নিজের পরিবার নিয়ে নিজের মতো করে থাকতেন। ফরবিডেন সিটির আলীশান সব কাজকারবার না দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে আজ থেকে এত শত বছর আগেও সম্রাটেরা কি ভোগ বিলাসে জীবনযাপন করতেন!
চীনা মিং ও কিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে যখন সম্রাটেরা এখানে বসবাস করতেন তখন অনুমতি ছাড়া কারো পক্ষে এখানে প্রবেশ কিংবা বাইরে যাওয়া অসম্ভব ছিল। সম্রাটের পরিবারের সদস্য ও দাওয়াতপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগনই শুধুমাত্র ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশ করতে পারতেন। এমনকি রাজপরিবারের বহু পুরুষ আত্মীয়ও জীবনে কোনদিন ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশ করার সুযোগ পাননি। আবার এখানে যারা বসবাস করতেন তারাও ইচ্ছে করলেই বাইরে যেতে পারতেন না। যথাযথভাবে অনুমতি নেয়ার পরই কেবল বাইরে যাওয়ার সুযোগ হতো। সেই অনুমতি প্রদান করা হতো বেশ উপরমহল থেকে, অনুমতি জুটতোও কেবলমাত্র রয়েল ফ্যামেলির সদস্যদের। সাধারণ মানুষের পক্ষে ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশ ছিল অকল্পনীয়। কেউ কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতো না যে তারা ফরবিডেন সিটিতে হাওয়া খাচ্ছে। কার্যতঃ এখানের দন্ডমুন্ডের কর্তা সম্রাটেরা চাইতেন না যে ফরবিডেন সিটির আলীশান ভবনগুলোতে বসবাসকারী তাদের পত্নী এবং উপপত্নীরা অন্য কোন পুরুষের নজরে পড়ুক। বাইরের জগত থেকে পত্নি ও উপপত্নীদের সুরক্ষিত রাখতেই মূলতঃ এখানে এত রকমারি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল! এটি কী স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা, সন্দেহ, অবিশ্বাস নাকি অন্যকিছু কে জানে ! ছায়া ঢাকা, পাখী ডাকা এই স্বপ্নপুরীতে কত দীর্ঘশ্বাস যে ইথারে মিলেছে তাও মানুষের অজানা রয়ে গেছে!!
ব্যাপক কড়াকড়ি এবং বাইরের লোকজন থেকে আড়াল রাখার কঠিন এবং কঠোর সব কর্মকান্ডের কারণে ফরবিডেন সিটি হয়ে উঠা অঞ্চলটি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে সাধারণ মানুষ যে কী নিদারুণভাবে ক্ষমতার কাছে অসহায় ছিল। ফরবিডেন সিটির পরতে পরতে ক্ষমতার দোর্দন্ড প্রতাপই কেবল দৃশ্যমান!
ফরবিডেন সিটির অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কড়াকড়ির একটু বর্ণনা দিলেই বুঝতে পারবেন যে, আজ থেকে ছয়শ’ বছরেরও বেশি আগেও কী মারাত্মক রকমের কড়াকড়ি সেখানে বিরাজমান ছিল। ফরবিডেন সিটির চারপাশ ২৬ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পুরো অঞ্চলটিকে ২৬ ফুট উঁচু বেশ চওড়া দেয়াল দিয়ে ঘিরেও নিশ্চিন্ত ছিলেন না সম্রাটেরা। খাড়া দেয়ালের বাইরে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল বিশাল এবং গভীর এক কৃত্রিম লেক দিয়ে। লেক নির্মাণ করেও ক্ষান্ত হননি সম্রাটেরা। তারা স্বচ্ছ জলের ওই লেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন মিঠা পানির কুমির। লেকজুড়ে ঘুরে বেড়াতো কুমিরের পাল। যাতে শত্রুদের কেউ লেক সাঁতরে নিষিদ্ধ এই প্রাঙ্গণে পা রাখতে না পারে। খাড়া দেয়াল কিংবা লেকে কুমির ছেড়েও ফরবিডেন সিটিতে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি প্রেমাতুর সম্রাট। মাটির তলা দিয়ে কেউ যেন ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য পুরো এলাকার ফ্লোর প্রায় ৫ ফুট গভীর থেকে ১৫ স্তরের ইটের সলিং করে ঢেকে দেয়া হয়। এতে করে কোন মানুষের পক্ষেই অননুমোদিতভাবে ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশের কোন সুযোগ ছিল না। কেউ কোনদিন চেষ্টা করেছে বলেও শোনা যায়নি। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝে দেয়াল এবং কৃত্রিম লেকে ঘেরা এলাকাটিতে অত্যন্ত নান্দনিকভাবে গুছিয়ে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য প্রাসাদ ভবন। এসব ভবনকে ঘিরে রয়েছে বাগান,ভাস্কর্য এবং ছোট ছোট লেক। সেই ক্ষমতার কিছুই আজ আর অবশিষ্ঠ নেই। সব রাজাই বিলীন হয়ে গেছেন। ক্ষয়ে গেছে সব রাজবংশ। আজ অতি সাধারণই শুধু নয়, আমার মতো অতি অভাজনও অবলীলায় চক্কর মারছি সেই দোর্দন্ড প্রতাপের সম্রাট কিংবা রাণীর বেডরুম থেকে ওয়াশরুম পর্যন্ত সর্বত্র! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।











