জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা সম্মানিত সকল নবীদের উম্মতদের উপর উম্মতে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মর্যাদা দান করেছেন। সকল নবীদের উপর আমাদের মহান নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যেমনিভাবে সকল ধর্মের উপর আমাদের পবিত্র দ্বীনকে ফজিলত দান করেছেন। আমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি যে, কুরআনের স্বাক্ষ্য অনুযায়ী আমাদের শ্রেষ্ঠ উম্মত করেছেন। মানবজাতির কল্যাণের জন্য যাদের আবির্ভাব হয়েছে।

নবীজির পবিত্র সত্তা সৃষ্টিকূলের সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত: মহান আল্লাহ আমাদেরকে অসংখ্য নিয়ামতরাজি দান করেছেন। ধরাধামে নবীজির শুভাগমন আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মীনদের উপর বড় অনুগ্রহ করেছেন, যে তাদের মধ্যে এক মহান রাসূল প্রেরণ করেছেন। আমাদের কর্তব্য হলো প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমন উপলক্ষে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ও খুশী উদযাপন করা। মহান আল্লাহ তাঁর সুমহান শান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন, তিনি তাওহীদ ও রিসালাতের আওয়াজ বুলন্দ করেছেন, পাহাড়পর্বত, নদনদী, সর্বত্র তিনি দ্বীনের ধ্বনি সমুন্নত করেছেন, বিশ্বব্যাপী তাঁর দ্বীনি দাওয়াতী কার্যক্রম সর্বত্র সম্প্রসারিত হলো। সকল ভ্রান্ত মতবাদের উপর ইসলামের বিজয় সূচিত হলো। যদিও তা কাফিরদের নিকট অপচন্দনীয়।

নূর নবীজির শুভাগমনে মীলাদুন্নবীর খুশী প্রকাশ ও আনন্দ উদযাপন: মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, হে নবী আপনি বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে তারা যেন খুশী উদযাপন করে। এটি তাদের সমুদয় সঞ্চয় থেকে অধিক উত্তম। (সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৫৮) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, আয়াতের তাফসীরে “ফাদ্বলুল্লাহ” আল্লাহর অনুগ্রহ দ্বারা ইলমকে বুঝানো হয়েছে, আর “রহমত” দ্বারা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টি রাজির জন্য কল্যাণের মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রেরণ করেছি। (তাফসীরে রুহুল বয়ান ১১/১৪১)

হাদীস শরীফের আলোকে মীলাদুন্নবী উদযাপন: মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনায় অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। আমাদের জন্য উত্তম আমল হলো নবীজির শুভ জন্মদিন উপলক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, খুশী উদযাপন করা, ইজতিমা তথা ধর্মীয় সমাবেশ, দরুদসলাম পাঠ করার আয়োজন করা, তাবাররুক পরিবেশন করা ইত্যাদি আমলসমূহ আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন ও খুশী উদযাপন’র উপলক্ষ ও বহি:প্রকাশ মাত্র।

হাদীস বিশারদ আল্লামা আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে কলবী (.) বিরচিত কিতাবুত তানভীর ফী মাওলিদিল বশীর ওয়াননযীর কিতাবে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, প্রখ্যাত সাহাবা হযরত আবু দারদা (.) এর ঘরে দেখতে পেলাম যে হযরত আবু আমের আনসারী (.) তাঁর সন্তানাদিসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বেলাদত তথা শুভ জন্ম দিবসের বৃত্তান্ত শুনাচ্ছেন। তিনি বলেন, আজকের এ দিন (মীলাদের দিন) নবীজি এরশাদ করেছেন হে আমের নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা তোমার জন্য রহমতের দরজা উন্মুক্ত করেছেন এবং ফেরেস্তারাজি তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। (আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ূতী কর্তৃক বিরচিত সাবিলুল হুদা ফি মউলিদিল মুস্তফা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (.) কোন একদিন তাঁর গৃহে লোকদের সমবেত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলাদতের ঘটনাবলী বর্ণনা করছিলেন, যা দর্শনে সকলে আনন্দোৎফুল্ল হয়ে নবীজির উপর দরুদসালাম প্রেরণ করলেন, এমন সময় নবীজি তথায় উপস্থিত হলেন এবং এরশাদ করেছেন, তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত অবধারিত হয়ে গেল।

মিলাদুন্নবীকে ঈদ হিসেবে পালন করা কুরআন হাদীস সম্মত: ঈদ অর্থ খুশী, আনন্দ, মিলাদ অর্থ জন্মদিন, জন্মকাল। এ অর্থে ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ অদৃশ্যের সংবাদদাতা আল্লাহর প্রেরিত বান্দা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগমন উপলক্ষে শরয়ী পন্থায় খুশী, আনন্দ উদযাপন করা। এতদ উপলক্ষে নবীজির জন্মকালীন অলৌকিক ঘটনাবলীর বর্ণনা করা, তাঁর বাল্যজীবন, শৈশব, কিশোর জীবন, মক্কী জীবন, মদনী জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, হিজরত, জিহাদ, ইসলামী দাওয়াত প্রচার সম্প্রসারণ, কাফিরদের বিরোধীতা, জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণ সত্বেও ইসলামের উপর অটল ও অবিচলতা সার্বিক বিষয়াদির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করার নামই মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মিলাদুন্নবী বিদ্বেষী এক শ্রেণির লোকেরা প্রচার করে থাকে ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দুই ঈদ ছাড়া তৃতীয় কোন ঈদের অস্তিত্ব নেই। এ দাবী ভিত্তিহীন, মনগড়া, কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। দেখুন! ঈসা ()’র উপর আসমান থেকে খাবার ভর্তি দস্তরখানা অবতীর্ণ হওয়ার দিন, আরাফাতের দিন, শুক্রবার জুমার দিনসহ আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত প্রাপ্তির দিন সমূহকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করার বর্ণনা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আল কুরআনে ঈদ শব্দের ব্যবহার: ঈসা ইবনে মরিয়ম বলেন, হে আল্লাহ! হে আমাদের প্রভূ আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। এটা হবে আমাদের পূর্ববতীও পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ স্বরূপ। (সূরা: আল মায়িদা, আয়াত: ১১৪)

আসমান থেকে খাদ্য অবরতণের দিবস যদি ঈদের দিবস হয়। যে দিন সমগ্র সৃষ্টির মূল ধরাধামে তাশরীফ এনেছেন সে দিন কেনই বা ঈদের দিবস হবে না? ঈদে মীলাদুন্নবী হিসেবে এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতইনা গুরুত্ববহ কতইনা আনন্দের। কুরআনের আয়াত অবতরণের দিন যদি ঈদের দিন হয়। ছাহেবে কুরআনের শুভাগমন দিবস অবশ্যই ঈদের দিবস। আমীরুল মুমেনীন হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, এক ইয়াহুদী লোক আমীরুল মুমেনীনকে বললেন, হে আমীরুল মুমেনীন, আপনারা আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত পাঠ করেন, সে ধরনের আয়াত যদি আমাদের উপর নাযিল হতো, সে দিনকে আমরা ঈদ হিসেবে পালন করতাম। আমীরুল মুমেনীন বলেন, সে আয়াত কোনটি? তখন ইয়াহুদী বলল, আল ইয়াওমা আকমালতুলাকুম দ্বীনাকুম …….. তখন হযরত ওমর (.) এরশাদ করেন, আমরা সে আয়াত এবং আয়াত নাযিল হওয়ার স্থানকে জানি। (মুসনাদ আবু য়া’লা: ১৩৪)

জুমাআর দিন মুসলমানদের ঈদের দিন: প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় এটা (জুমাবার) ঈদের দিন। আল্লাহ তা’য়ালা এটা মুসলমানদেরকে দান করেছেন। (নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ১৬৬৬) নবীজির জন্ম দিনে নবীজি রোজা রেখেছেন মর্মে মুসলিম শরীফের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মিলাদ বিদ্বেষীরা অভিযোগ করে এ দিন উম্মত হিসেবে রোজা না রেখে মিলাদ আয়োজন করা, জশনে জুলুস বের করা, সভাসেমিনার আয়োজন করা, আলোক সজ্জা করা, তাবাররুক বিতরণ করা ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা বিদআত। এসব জ্ঞান পাপীদের উপরোক্ত বক্তব্য, মন্তব্য অজ্ঞতা ও মূর্খতার পরিচায়ক। অথচ নবীজি রাহমাতুল্লীল আলামীন হিসেবে শুভাগমনের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ খুশী, আনন্দ উদযাপন করা মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনের অনুসরণ। উম্মত ঈদের দিন হিসেবে রোযা না রাখা নবীজির নির্দেশ। যেমন জুমার দিনকে ঈদের দিন বলা হয়েছে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় জুম’আর দিন হল ঈদের দিন, তোমরা ঈদের দিনকে রোজার দিন করোনা। তোমরা এর আগে বা পরের দিন রোজা রাখ। (নাসায়ী শরীফ: ১৬৬৬)

মীলাদুন্নবী উপলক্ষে জুলুস বা শোভাযাত্রা: বিশ্ব মানবতার কাণ্ডারী, মুক্তির দিশারী, বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত, কল্যাণের মূর্ত প্রতীক, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধরাধামে শুভাগমনের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র রবিউল আউয়াল শরীফে নবীজির শুভ জন্ম দিন উদযাপনের স্মারক হিসেবে মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জশনে জুলুস তথা শোভা যাত্রা আয়োজন, নূর নবীজির আগমনে সম্মান প্রদর্শন ও মহান আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামান্তর। হিজরতের পাক্কালে নবীজি মদীনা মুনাওয়ারায় পদার্পন করলে সানিয়্যাতিল বিদা নামক স্থানে আনসার সাহাবা কেরামের প্রাণঢালা অভ্যার্থনা জ্ঞাপন, জশনে জুলসের অভ্রান্ত দলীল ও ঐতিহাসিক ভিত্তি। যেমন হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফ থেকে মদীনা মনোওয়ারা পৌছলে নবীজিকে অভ্যার্থনা জানানোর জন্য মদীনার পুরুষ মহিলার ঘরের ছাদে আরোহন করেন, মদীনার শিশু কিশোরেরা রাস্তার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন, সকলে সম্মিলিত ভাবে উচ্চস্বরে শ্লোগান দিতে থাকেন ইয়া মুহাম্মদ ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া মুহাম্মদ ইয়া রাসুলাল্লাহ। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং : ২৩১১)। হে আল্লাহ! আমাদের কথায় কাজে কর্মে ও পবিত্র নিয়্যতে আপনার সন্তুষ্টি দান করুন। হে আমাদের অভিভাবক নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার ভালবাসা ও আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা নসীব করুন। আমাদের আপনাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন, কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা পরিত্রাণ নসীব করুন। নিশ্চয়ই তিনি দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল, দয়ালু, আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকানাইমাদারী কাদেরীয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় মতবিনিময় সভা
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় মাদ্রাসা শিক্ষকের রাজকীয় বিদায়