চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ ও গ্লোকোমা

ডা. এম এ করিম | মঙ্গলবার , ১৫ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ


গ্লোকোমা একটি চোখের জটিল রোগ। যাকে দৃষ্টির নীরব ঘাতক বলা হয়ে থাকে। মানুষ যখন গ্লোকোমা নামটি শুনে তখনই তাদের মনের মধ্যে চোখের উচ্চচাপ এর ধারণা চলে আসে। কিন্তু গ্লোকোমা এবং চোখের চাপের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং ক্রমান্বয়ে তা পরিবর্তিত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে গ্লোকামাকে বলা হতো এমন একটি চোখের রোগ যেখানে চোখের উচ্চচাপের জন্য চোখ থাকতো শক্ত ও কঠিন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এটি প্রতিয়মান হয় যে, চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ স্বাভাবিক থাকা অবস্থায়ও গ্লোকোমা হতে পারে যা মাঝে মাঝে ডাক্তারদের পক্ষে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। একটি নিরীক্ষায় দেখা গেছে যে, গ্লোকোমা নির্ণয়ের সময় শতকরা ৫০% রোগেীর চোখের চাপ স্বাভাবিক থাকে। এই জন্য চোখের চাপকে গ্লোকোমার প্রধান দায়ী একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে গ্লোকোমাকে সংজ্ঞায়িত করতে চোখের চাপকে ব্যবহার করা হয়না। যদিও বেশীর ভাগ গ্লোকোমা রোগীর ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বেশি থাকে। কিন্তু চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণই গ্লোকোমার একমাত্র চিকিৎসা বলে বিবেচিত হয়।
গ্লোকোমাকে বলা হয় অপটিক নার্ভ এর রোগ, যেখানে এই নার্ভ ক্রমান্বয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে যা রোগীরা কোনভাবেই প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে পারেনা। অপটিক নার্ভ এমন একটি সংবেদনশীল সংযোগ যা চোখের সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ স্থাপন করে আমাদের চোখের দৃষ্টিকে সংরক্ষণ করে থাকে। প্রাথমিক ভাবে বুঝতে না পারলেও যখন দৃষ্টির পরিসীমা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে শেষ সীমানায় চলে আসে তখনই তারা বুঝতে পারে। কিন্তু তখন আর কিছু করার সুযোগ থাকেনা। কারন একমাত্র চিকিৎসার মাধ্যমে গ্লোকোমা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তবে দৃষ্টশক্তি উন্নতির কোন সুযোগ থাকেনা।
বয়সের সাথে সাথে যদিও চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধিপায় তথাপি গ্লোকোমার ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া নির্ভর করে অপটিক নার্ভ এর স্নায়ুর সুস্থতার উপর। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় চোখের উচ্চচাপ থাকা সত্ত্বেও নার্ভের সুস্থতা বজায় থাকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখের চাপ স্বভাবিক থাকা অবস্থায়ও গ্লোকোমার ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া অব্যহত থাকে। চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ নিয়ন্ত্রণই গ্লোকোমার একমাত্র চিকিৎসা। চোখের চাপ বেশি অথবা স্বাভাবিক যে পর্যায়ে থাকুক না কেন তা একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণই চিকিৎসার উদ্দেশ্য। চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ এর জন্য চোখের ড্রপ, লেজার ও অপারেশন এর প্রয়োজন হয়ে থাকে।
প্রাথমিক ভাবে চোখের ড্রপ ও প্রয়োজনে লেজার রশ্মির মাধ্যমে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। যখন এই দুই পদ্ধতিতে চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয় তখন অপারেশন এর মাধ্যমে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণের শেষ চেষ্টা করা হয়ে থাকে। চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করার কোন উপায় থাকেনা। উপসর্গ বিহীন এইরোগ উন্নত বিশ্বেও শতকরা ৫০% জন মানুষ জানেনা যে তারা গ্লোকোমা রোগে ভুগছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে এই রোগের অবস্থা এবং সচেতনতা খুবই ক্ষীণ। এই জটিল রোগ থেকে আমাদের দৃষ্টি সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতা ও নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই।
আসুন আমরা সবাই গ্লোকোমা নামক দৃষ্টির নীরব ঘাতক এই রোগ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি এবং সরকারী ও বেসরকারিভাবে জনসচেতনতার উদ্যোগ নেই। নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগকে প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে, পরিমিত চিকিৎসা নিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রিত রেখে দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করে অন্ধত্বর অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করি।
লেখক : গ্লোকোমা বিশেষজ্ঞ, শেভরন আই হসপিটাল এন্ড রিসার্চ সেন্টার

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্র নেতৃবৃন্দের জাতিকে মুক্ত করার দৃপ্ত ঘোষণা
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল