এসো হে বৈশাখ, এসো এসো

রেজাউল করিম | বুধবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৮:০০ পূর্বাহ্ণ

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের দুটি বছর গেল বিষাদে। এ সময় আমরা হারিয়েছি অনেক আপনজন, জ্ঞানী-গুণীদের। অনেকটা স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি এখন বিরাজমান। বছর ঘুরে এল বৈশাখ। বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি একেবারে শেষ। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক/ এসো এসো…/ যাক পুরাতন স্মৃতি/ যাক ভুলে যাওয়া গীতি/ যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ যাক যাক/ এসো এসো…/ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা…।’
বৈশাখের প্রথম দিনটি বাংলা নববর্ষ। বাঙালির চিরায়ত উৎসব। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।
বঙ্গাব্দের গোড়াপত্তন : নববর্ষ একসময় ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে উদযাপিত হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। এই কৃষিকাজের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয়। তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন আকবর। সম্রাটের নির্দেশে আমির ফতেহউল্লাহ শিবাজি এ কাজটি করন। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
হালখাতা : বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব হালখাতা। এর পুরোটাই অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। তবে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে এই হালখাতা অনেকটা ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। শহরে অত্যন্ত সীমিত, এমনকি গ্রামেও হালখাতার প্রচলন উঠে যাচ্ছে।
মিষ্টিমুখ : নববর্ষে গ্রাম এমনকি শহুরের অনেকে বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে গোসল সারে। দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরকে মিষ্টিমুখ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
শুভেচ্ছা বিনিময় : নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও প্রচলিত। এখন শুভেচ্ছা জানানোর আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে মুঠোফোনে খুদে বার্তা, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ সাইটে স্ট্যাটাস।
নগরে বর্ষবরণ : গ্রামের চেয়ে নগরে এখন অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উৎসবের শুরু। ১৯৬৭ সালে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ গঠনের মাধ্যমে রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের যে সূত্রপাত ঘটে, তা পাকিস্তান আমলে বাঙালির প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার চেতনার এক দীপ্র প্রতীক হয়ে ওঠে। ছায়ানটের সেই অনুষ্ঠান প্রতিবছর বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে নাগরিক বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে এমন এক জাতীয় উৎসব বাঙালি জীবনের অনন্ত প্রেরণার উৎস। চট্টগ্রামে ডিসি হিল, সিআরবির শিরীষতলায় প্রাণের টানে আসে, মেতে ওঠে উৎসবে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন বর্ষবরণে বর্ণাঢ্য আয়োজন করে থাকে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা : স্বাধীনতার পর বর্ষবরণে আসে নানা রঙ, অনুষঙ্গ। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকরা বর্ষবরণে আনে ভিন্নতা। তারা বের করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ -বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমির, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ, সাজসজ্জা, বাদ্য-বাজনা, নানা বৈচিত্র্য এতে সন্নিবেশিত হয়। আর এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ২০১৬ সালে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে আসছে। আর এতে যোগ দেয় সব শ্রেণির লোকজন।
বৈশাখী মেলা ও বলীখেলা : নগরে বর্ষবরণের পাশাপাশি বৈশাখী মেলা বসে। চট্টগ্রামে ডিসি হিল, সিআরবির শিরীষতলায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আয়োজন করা হয় নানা আয়োজনের। সিআরবিতে সাহাবুদ্দীনের বলী খেলা, মোরগ লড়াই বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে এনেছে ভিন্নতা। নগরীর বিভিন্নস্থানে বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়। বসে মেলা। আর ১২ বৈশাখ বসে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার। লালদীঘি ও এর আশেপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে এই মেলা বসে থাকে। মেলায় স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন : চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, নানা ধরনের মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্রময় সমারোহ থাকে মেলায়। পাহাড়ে হয় বৈসাবি উৎসব। বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু-এই তিনটি উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি উৎসব। পুরানো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পাহাড়ে তিন দিনের এই উৎসব উদযাপিত হয়। সমতল-পাহাড়ে বাসিন্দাদের কাছে নববর্ষ আসে মঙ্গল কামনায়।
আঁধার ভেদ করে উদিত হয় নতুন সূর্য। নতুন বছর সবার জীবনে কল্যাণ বয়ে আনুক -এমনটাই প্রত্যাশা। আজ নতুনের কেতন উড়বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযখন আসে বোশেখটা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের উন্নয়নে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে