একাত্তরের খণ্ডচিত্র

জিনাত আজম | বৃহস্পতিবার , ৪ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

২০ মার্চ ১৯৭১। আগ্রাবাদ জাম্বুরী মাঠের পাশেই আমার নতুন সংসার। আমরা এসেছি এই এলাকায় সপ্তাহখানেক হবে। আজম সাহেবের নতুন অফিস পোর্ট ব্রাঞ্চ (পূবালী ব্যাংক) তৎকালীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক। কালুরঘাট, মোহরা থেকে অফিস দূরে হওয়ায় বাড়ি থেকে আমাদের বের হয়ে এখানে আসা। এর আগে যৌথ পরিবারে সবাই মিলে থেকেছি আনন্দের সাথেই। তবে নতুন আলাদা টোনাটুনির সংসারের রোমাঞ্চ তো অবশ্যই আছে। কিন্তু নতুন ঘর গোছাতে না গোছাতেই চারিদিকের গুঞ্জনে সব যেন এলোমেলো লাগছে। দেশের অবস্থা ভালো না। চারিদিকে ফিস্‌ফাস্‌, “সহজে শেখ মুজিবকে ওরা ছাড় দেবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েও পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বিমুখী নীতি, অন্যায়, সব যেন আরও বেড়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর এই দ্বীমুখী নীতি কত আর সহ্য করা যায়। এবারে পূর্ব বাংলার মানুষও জেগেছে। চতুর্দিকে তারই আভাস।” সন্ধ্যায় আজম সাহেবের এক কলিগ এলেন আমাদের বাসায় সস্ত্রীক। সেই সাথে তিনিও জানিয়ে গেলেন এই পূর্বাভাস। ভাবছিলাম কেন যে এলাম বাড়ি ছেড়ে! আরও পরে এলেই হতো।

২৫ মার্চ রাতেই এই আগাম বক্তব্য ফলে গেলো। মর্টার, কামানের গোলাসহ প্রচণ্ড গোলাগুলির মুহুর্মুহু শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হচ্ছেসারারাত। আমরা দুজন সাথে ছোট্ট লিনা। ডাক্তার আমাকে আতিকের জন্মের ডেট দিয়েছে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। একে তো শরীরের এই হাল, রাতের সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে কী করবো, কোথায় যাবো আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কে যেন নিচ থেকে জানালেন পাকবাহিনি আক্রমণ শুরু করেছে। সম্ভবত পোর্ট এলাকায়। আমরা প্রচণ্ড ভয়, টেনশনে একামরা ওকামরা করছি। অর্থাৎ কোন দিকে গেলে নিরাপদ হবে সেটা বুঝতে পারছি না। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্য দিয়ে ২৫ শে মার্চের সেই কাল রাত পার করলাম আমরা। জানলাম ওরা গভীর রাতে নিরস্ত্র মানুষের (সেনাবাহিনি, পুলিশ) হামলা করেছে। এর মধ্যেই ঘন ঘন গুলি বর্ষণের শব্দ, মর্টারশেলের আওয়াজ মানুষ জেনে গেছে পাকিস্তানিদের (সেনা) সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বাঙালি সেনাদের। বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ। বিবিসি বাংলা বেতার থেকেও জানা হলো বিস্তারিতভাবে।

সেদিনের সেই ভোরে আমাদের দরজায় ঘন ঘন বেল এবং কড়াঘাত। দরজা খুলতেই দেখা গেলো আজম সাহেবের পোর্ট ব্রাঞ্চের এক কর্মচারীকে। কোনো ভূমিকা না করেই তিনিও ঘোষণা দিলেন “স্যার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানিদের সাথে। আমিও যুদ্ধে যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।” দুঃখের সাথে বলতে হয়, দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁর সাথে সেদেখা আর হয়নি। এমনকি তাঁর কোনো খবরও আমরা পাইনি। এমন কত বাঙালি বীর যোদ্ধাই দেশের জন্য নির্বিচারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেনআমরা ক’জনার খবরই বা রাখি! এরপরও বলতে হয় এই মহান আত্মত্যাগের জন্য অযুত যোদ্ধারা কালের পাতায় চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।

প্রকৃতপক্ষে সপ্তাহখানেক ধরেই একটা গরমিল ছিলো। ভুট্টো ইয়াহিয়া গংএর সাথে শেখ মুজিবের (বঙ্গবন্ধু) ঘন ঘন বৈঠক ও আলোচনা কোনো সুযোগ বয়ে আনেনি। অবশেষে আমাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতেই যুদ্ধের ঘোষণা দেন। এর পরেই পাকিস্তানিরা তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। ২৩/২৪ তারিখে সোয়াত জাহাজ অস্ত্রবোঝাই হয়ে বন্দরে ভিড়লে অস্ত্রখালাসের সময় বাঙালি সেনারা বাধা দেয়ায় তাদের সাথে গোলাগুলি হয়। বলা যায়, যুদ্ধের সূচনাও এখান থেকেই। ২৫ শে মার্চ রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত সেনাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেককেই বর্বর পাকসেনারা হত্যা করে। পুলিশবাহিনিও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

২৬ শে মার্চ নবগঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমত মেজর জিয়া তাঁর পক্ষে স্বাধিকার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে…….

সারা দেশ ও দেশের আপামর জনতা জেগে ওঠে। রুখে দাঁড়ায় সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ঘরে ঘরে তরুণ, যুবকসহ অসংখ্য বাঙালি এই অসমযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বর্ডার পেরিয়ে অনেকেই ভারতে পৌঁছে যান। তাঁদের হাতে সে সময় না ছিলো অস্ত্র, না ছিলো যুদ্ধের কোনো প্রশিক্ষণ। খালি হাতেই অকুতোভয় বীরেরা অমিত তেজে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন ওপার বাংলায়। এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ মাতৃকার জন্য। স্বাধীনতার জন্য। কালুরঘাট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। দেশের গান, এম আর আখতারের ‘চরমপত্র’, রাজু আহমেদের জল্লাদের দরবার সহ বিভিন্ন উদ্দীপ্তমূলক অনুষ্ঠান সকলকে উজ্জীবিত করে তোলে নব উদ্যোমে।

আমরা থাকি দোতলায়। বাড়িওয়ালা পরিবার নিয়ে থাকেন নিচতলায়। তাঁর বড় ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে বেশিদিন হয়নি। স্বাধীনতার পরে শুনেছিলাম অনেকের সাথে সেই ছেলেকেও পাকসেনারা গুলি করে মেরেছে। বেচারা পানির ট্যাঙ্কে লুকিয়েও বর্বর জল্লাদদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এদিকে সারাক্ষণই গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তা সুনসান। দোকানপাট বন্ধ। আমরা ভাবছি কী করবো? এই সময় ঘর ছেড়ে বের হওয়াটা কতটা নিরাপদ! বিশেষ করে দেড় বছরের লিনা এবং অন্তঃস্বত্তা আমি! কোনো যানবাহনওতো পাওয়া সম্ভব নয়। ঘরে রসদ যা আছে তাই দিয়ে আমরা চলছি প্রায় তিন দিনের কিছু বেশি হবে। বাচ্চার দুধ ফুরিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য রসদেরও টান পড়ছে। একদিন রান্নাঘরে বসে পড়েথাকা বাসী সবজি নাড়াচাড়া করছি। এমনি সময় ভূত দেখার মতোই আমার দেবর আলী নেওয়াজ খানকে (সবাই টুকু বলে ডাকে) দেখলাম। প্রথমত ভেবেছিলাম চোখের ভ্রম, কল্পনায় দেখছি। কিন্তু না সত্যিই টুকু বলে উঠলো, ‘ভাবী তাড়াতাড়ি রেডি হন। আমি লোক নিয়ে এসেছি। সে সমস্ত পথ চিনে। পাড়ার ভেতর, গলি ঘুপচি দিয়ে আমরা বেরিয়ে যাবো।’ পনেরোবিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা যৎসামান্য কিছু জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেই লোক সত্যিই করিৎকর্মা। আমাদেরকে সে যখন আগ্রাবাদের বিভিন্ন পাড়ার ভেতর দিয়ে ড্রেন পেরিয়ে গলিঅন্যগলির ভেতর দিয়ে হেঁটে অন্য পারে উঠলাম, এমন সময় মূর্তিমান এক বৃদ্ধ লোকের সাথে দেখা। মূল সড়কের উপর থেকে এখানেও গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। সেই বৃদ্ধ ভুরু কুঁচকে প্রচণ্ড বিরক্তি সহকারে আমাকে অবলোকন করে উঁচু গলায় চাটগাঁইয়া ভাষায় খেঁকিয়ে উঠলেন, “অডা, তোরা মইরলে মরগুই। এই মাইয়্যা পোয়ারে কিল্লাই বাইর গইরজ্যুস?” এর জবাব কেউই দেয়নি। সারাটা কঠিন পথ ওরা দুভাই মিলে আমার এই ভারী শরীরসহ আমাকে হাত ধরে তুলছেনামাচ্ছে। এখন ভাবা যায়!

এভাবেই সেদিন সহিসালামতে প্রায় ১০১২ মাইল পথ হেঁটে বাড়িতে পৌঁছালাম। পথে একটা রিকশা পাওয়াতে রক্ষা। আর রিকশাও এতসব অচেনা কাঁচা রাস্তায় চালানো যে কতটা দূরূহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ মনে হয় সেদিন আমাকে দেখে সেই রিকশাওয়ালা ভাইয়েরও বুঝিবা মনে করুণা জেগেছিলো। মোহরায় পৌঁছাতেই সবাই জড়িয়ে ধরলো। আমার শাশুড়িমা তো কেঁদেই আকুল। শুনলাম তিনদিন ধরে তিনি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন আমাদের কথা ভেবে ভেবে।

(ক্রমশ)

লেখক : রম্যসাহিত্যিক, সাবেক সভানেত্রী, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইছামতী খাল : ভাঙন প্রতিরোধে করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল