‘ইতিহাসের আড়ালে ইতিহাস’ পাঠ অনুভূতি

মোহছেনা ঝর্ণা | শনিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি দেশের নাগরিকত্বও যে কারো স্বপ্ন হতে পারে ভাবতেই অবাক লাগে! কিন্তু স্বপ্নই ছিল ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রানসিস হল্টের কাছে। ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হেলেলে জন্ম। বাবা জন হল্ট। মা ফ্রানসিস হল্ট। ১৯৬০ সালে তরুণ বয়সে অক্সফোর্ড মিশনে একজন কর্মী হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। সেই যে এসে মায়ার বাঁধনে পড়লেন তারপর থেকে এই মায়া কেবল বেড়েই চলেছে। গত ৫৭ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষদের ভালোবেসে তাদের সেবা করে চলছেন। বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করলেও মানব সেবা চলমান তার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহতদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। বিদেশ থেকে ফান্ড আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের নাগরকিত্ব প্রদান করে তার স্বপ্ন পূরণ করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মের সময় তাদের এলাহাবাদের আনন্দ ভবনে ইন্দিরার দাদা মতিলাল নেহেরু এবং ইন্দিরার বাবা জহরলাল নেহেরুসহ সকলেই অপেক্ষা ছিলেন একটি পুত্র শিশুর। কিন্তু তাদের অপেক্ষাকে ম্লান করে কেঁদে উঠল একটি কন্যা শিশু। ইন্দিরার দাদি এসে কন্যা শিশুর খবর দিলে অপ্রস্তুত দাদা মতিলাল নিজেকে সামলে নিয়ে হো হো করে হেসে ওঠেন। দৃশ্যটুকু চিত্রপটে ভাসছে যেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ধারা। সে রাজ্যের কর্তা ব্যক্তিই হোক আর অতি সাধারণ নাগরিকই হোক।
এই অংশগুলো প্রাবন্ধিক কাজী রুনু বিলকিস এর লেখা বই ‘ইতিহাসের আড়ালে ইতিহাস’ থেকে বলছি। বিভিন্ন সময়ে লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ এক মলাটে সাজিয়ে এই সুন্দর আয়োজন। ইতিহাসের নানা চরিত্র, যেমন – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, লুসি ফ্রানসিস হল্ট, জামাল খাসোগী হত্যাকান্ড, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডন, নোবেল বিজয়ী নাদিয়া মুরাদের সংগ্রাম, আমার মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলনে নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নানারকম ইতিহাস বিষয়ক লেখার পাশাপাশি সমসাময়িক অনেক প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে “ইতিহাসের আড়ালে ইতিহাস” বইতে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে লেখকের মুগ্ধতা , প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন মিশরের গল্প, বর্ষার দিনে জলাবদ্ধতা নিয়ে নিজ শহরের করুণ চিত্র, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, ফেনীর সাহসী কন্যা নুসরাত হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন কাজী রুনু বিলকিস।
‘একজন পাকিস্তানীর চোখে বাংলাদেশ’ শিরোনামের লেখাটিতে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আসিফ শাহকারের লেখা নিবন্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন চমৎকার ভাবে। আসিফ শাহকার তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তাানের স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর পর সেখানে লাখ লাখ ধর্ষিত ও অন্তঃসত্তা নারী ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ছাড়া কিছুই ছিল না।’ তাদের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ যখন তারাই নিজ মুখে স্বীকার করে তখন ক্ষমা চাওয়াটা তো শিরোধার্য হয়ে যায় তাদের জন্য। এরপরও যখন কেউ কেউ পাকিস্তান প্রীতি দেখিয়ে কথা বলে তখন তাদের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা চলে আসে।
এই বইয়ে আমার ভালো লাগার একটা প্রবন্ধ হলো ‘সাধারণ মানুষের ডায়েরি’। আহা! আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈন্যদশা! এতদিন আমরা ভুক্তভোগীরাই কেবল বলেছি। নীতিনির্ধারকদের কাছে সেগুলো প্রলাপের মতো মনে হয়েছে। এবারের অতিমারি দেখিয়ে দিয়েছে, কীরকম দৈন্যদশায় আছে আমাদের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা।
“ইতিহাসের আড়ালে ইতিহাস” প্রবন্ধটি বেশ সমৃদ্ধ। ভাষা আন্দোলনে আমাদের নারীদের অংশগ্রহণের কথা জানি। কিন্তু তাদের নাম প্রচলিত নয়। ভাষা আন্দোলন বললেই যেমন সালাম, বরকত, জব্বার চলে আসে সেরকম কোনো নারীর কথা কিন্তু আসে না। অথচ রানী ভট্টাচার্য, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, হালিমা খাতুন, ড. সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা, মমতাজ বেগম সহ আরও অনেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন মহান ভাষা আন্দোলনে। লেখক ছোট পরিসরে চমৎকারভাবে তাদের পরিচয় তুলে এনেছেন এই প্রবন্ধে।
‘ইতিহাসের আড়ালে ইতিহাস’ বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধ অনেক বড় বড় মানুষের জীবনী সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে পাঠকদের। না জানা অনেক তথ্য জানার সুযোগ আছে এই বইয়ে। সম সাময়িক বিষয়গুলোও পাঠকদের স্পর্শ করবে। প্রাবন্ধিক কাজী রুনু বিলকিস- এর প্রতি অনেক শুভেচ্ছা, শুভকামনা। আগামীতেও তিনি আরও নানান বিষয়ে লিখবেন। প্রতিবাদ করবেন। মানবতার পাশে দাঁড়াবেন – এই প্রত্যাশা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক অর্থনীতি অলিম্পিয়াড-২০২০ এবং বাংলাদেশের অর্জন
পরবর্তী নিবন্ধঐশ্বর্য শ্রীধর