আমাদের জীবনে শিক্ষা-দীক্ষার সমন্বয়

লিপি বড়ুয়া | রবিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি অপরিহার্য বিষয়। আমরা পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করি খুব সহজে কিন্তু চিন্তায়, চেতনায়, মেধায়, মননে সবসময় মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা কি করি? আমাদের প্রকৃত মানুষ হতে হলে অবশ্যই শিক্ষার সাথে দীক্ষার সমন্বয়ে করে নিজেকে গঠন করতে হবে। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষা যেমন নিজের জন্য প্রয়োজন ঠিক তেমনি শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড।

সুশিক্ষা বলতে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাস্তব জীবনের বিচিত্র প্রেক্ষাপট থেকে অর্জিত শিক্ষা। ‘সুশিক্ষা’ শব্দটি দুইটি শব্দ নিয়ে গঠিত। ‘সু’ যার অর্থ সঠিক এবং শিক্ষা যার অর্থ পাঠ বা জ্ঞান চর্চা করা। সুতরাং, সুশিক্ষা অর্থ সঠিক জ্ঞান চর্চা করা।

শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে।

দীক্ষা মানে উপদেশ বা আদর্শের জন্য একজন গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ। দীক্ষা শব্দটি শিক্ষার সাথে গভীর ভাবে সম্পর্কিত। বিখ্যাত মনীষীদের বিভিন্ন উপদেশের মধ্যে দীক্ষার মন্ত্র নিহিত রয়েছে।

শিক্ষা হলো যা জানলেন, আর দীক্ষা হলো শিক্ষাকে কাজে লাগানো। শিক্ষাকে মেনে চলা। দীক্ষার একমাত্র চালিকাশক্তি মেধা মনন। তাই এই মেধা সম্পন্ন মানুষ হতে হলে সুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

দেশ সেবার মন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের বঙ্গবন্ধু কন্যা মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একটি কথা সবসময় বলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করতে গিয়ে। ‘আব্বা আমাদের একটা কথা সব সময়ই বলতেন, রাজনীতি হলো দেশের মানুষের জন্য কিছু করা, নিজে কি হবে সেটা বড় কথা নয়। তাই রাজনীতি আমরা যা শিখেছি তা হলো রাজনীতির অর্থ দেশসেবা করা, মানুষের সেবা করা। এখানে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান বড় কথা নয়। নীতি ও আদর্শই হলো মূল্যবান’।

সুতরাং আমরা বলতে পারি দীক্ষা হলো শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে দেশ সমাজ তথা নিজেকে গঠন করা। শিক্ষার সাথে দীক্ষা না থাকলে সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা শিক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করছি তার ঠিক কতটুকু প্রতিফলন ঘটাতে পারছি নিজের জীবন, সমাজ জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে? আমরা হয়তো জ্ঞান অর্জন করছি কিন্তু অনুশীলন করছি না। আজকের সমাজে একটি বিষয় ভীষণভাবে লক্ষণীয় তা হলো আমরা অনেক কিছুই জানি কিন্তু অনেক বিষয় মানিনা কিংবা মানতে চাইনা।

নিজেকে শিক্ষিত বলছি সার্টিফিকেটের ভারে কিংবা কর্ম ক্ষেত্রে পদভারে ধরাকে সরা জ্ঞান করছি। কিন্তু আদৌ কি মানুষ হতে পেরেছি? প্রকৃত শিক্ষা দীক্ষায় পরিপূর্ণ একেকজন মানুষ? হয়তো না। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম কিন্তু দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। গুরুজনদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীলতার অভাব দেখা যায়। শিক্ষার সাথে দীক্ষার মন্ত্রে নিবেদিত নয় বলেই এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা দীক্ষার উপর জোর দিতে হবে আমাদের। মানবতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আগামী প্রজন্মকে ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা গদ্যগ্রন্থাবলীতে লিখেছেন ‘নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দ্বারাই অন্যের শ্রেষ্ঠতাকে আমরা জাগাতে পারি। তাতেই মঙ্গল আমাদের ও অন্যের। আত্মিক সাধনার একটি অঙ্গ হচ্ছে জড়বিশ্বের অত্যাচার থেকে আত্নাকে মুক্ত করা। এই যুগের অতিকায় ঐশ্বর্য, অতিকায় সাম্রাজ্য, সংঘবন্ধনের সমস্ত অতিশয়তা টুকরো টুকরো করে ভেঙে যাবে। সত্যকার স্বাতন্ত্র্যের উপর সত্যকার ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে। যারা নবযুগের নবরূপকার ঐক্যের সাধনার জন্যই তাদের স্বাতন্ত্র্যের সাধনা করতে হবে। এই সাধনায় জাতি বিশেষের মুক্তি নয়, নিখিল মানবের মুক্তি।

যাই হোক, এর চেয়ে স্পষ্ট আজ আর কিছুই নয় যে, জাতিতে জাতিতে একত্র হচ্ছে অথচ মিলছে না। এই বিষম বেদনায় সমস্ত পৃথিবী পীড়িত।
কবিগুরুর শিক্ষা গদ্যগ্রন্থাবলী আবরণ গল্পে লিখেছেন এ দেশে অতি পুরাকালে যখন লিপি প্রচলিত ছিল, তখনো তপোবনে পুঁথি ব্যবহার হয় নাই। তখনো গুরু শিষ্যকে মুখে মুখেই শিক্ষা দিতেন এবং ছাত্র তাহা খাতায় নহে, মনের মধ্যেই লিখিয়া লইত। এমনি করিয়া এক দীপশিখা হইতে আর এক দীপশিখা জ্বলিত। বালক অল্পমাত্র যেটুকু শিখিবে তখনি তাহা প্রয়োগ করিতে শিখিবে, তাহা হইলে শিক্ষা তাহার উপরে চাপিয়া বসিবে না। শিক্ষার উপর সে চাপিয়া বসিবে।

কবিগুরুর কথাগুলো এখন ধ্রুব সত্য হয়ে আমাদের সামনে প্রজ্জ্বলিত। আজ আমাদের বর্তমান সমাজে সাংঘাতিক ভয়াবহতা বিরাজমান। শিক্ষাকে পুঁথি পাঠের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখার কারণে লক্ষ্য স্থির করতে ভীষণভাবে বিপদে পড়তে হচ্ছে। শিক্ষার সাথে দীক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে তবেই সকল অপারগতা নিরসন হবে এবং শিক্ষাকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগিয়ে দেশ সমাজ তথা নিজেকে যোগ্য করে তুলতে সক্ষম হবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কারণ মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে ও শিক্ষাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা রাখে।

বুদ্ধির ক্ষমতা নির্জীবতা যে আমাদের প্রকৃতিগত নয় তার প্রমাণ – জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল রায়, ব্রজেন্দ্র শীল। আমাদের শিক্ষার একান্তদীনতা ও পরবশতা সত্ত্বেও তাদের বুদ্ধি বিদ্যা বিশ্বজ্ঞানের মহাকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজ বিজ্ঞানের জয়জয়কারও কোথাও না কোথাও মুখ থুবড়ে পড়ছে।

তাই আর অবহেলা নয়, এখন সময় এসেছে সচেতনভাবে প্রকৃত অর্থে শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সুগঠিত করার। সত্যিকারভাবে যদি শিক্ষা-দীক্ষার সমন্বয় ঘটাতে পারি তাহলে রক্ষা হবে মানবতা। মানুষের ভেতর জন্মাবে মানবপ্রেম। মানুষ দাঁড়াবে মানুষের পাশে স্বার্থহীনভাবে। সুন্দর হবে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। সত্যিকার অর্থে সকলে মানুষ হবো। আমাদের এই শিক্ষার সাথে জীবনের সামঞ্জস্যপূর্ণতা আজকের দিনের সর্বপ্রধান মনোযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে সকল মানুষকে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : কবি, সংস্কৃতি কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিঃসঙ্গ
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে