আমরা সবাই রাজা

মিলন বনিক | বুধবার , ১০ মে, ২০২৩ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

নেহাল আর নিতু। দুই ভাইবোন।

একই স্কুলে পড়ে। নেহাল সপ্তম শ্রেণিতে। নিতু তৃতীয় শ্রেণিতে। নেহালের ডে শিফট। সাড়ে এগারোটায় স্কুল শুরু। সকালে অফিস যাবার পথে বাবা নিতুকে স্কুলে দিয়ে যায়। আবার মা ভাইকে যখন স্কুলে পৌঁছে দেয়, ফেরার সময় নিতুকে নিয়ে আসে। নেহাল বড়। তাই মাঝে মধ্যে একা একাই স্কুলে যেতে পারে। আসতেও পারে।

এখন যখন একটু বড় হচ্ছে, নেহাল নিজেই একা একা পথ চলতে চেষ্টা করে। স্কুলে যেতে চায়। বাজারে যেতে চায়। বন্ধুদের সাথে এখানে ওখানে যেতে চায়। জামালখান মোড়ে গিয়ে আড্ডা দিতে মন চায়। পহেলা বৈশাখে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে মন চায়। বারণ করলে বলে, আমি কি দুধের শিশু, যে সারাক্ষন তোমাদের সাথে যেতে হবে। আমি কি একা যেতে পারি না।

নিতু যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হয় তখন থেকে স্কুলে যেতে খুব পছন্দ করতো। কখনো স্কুল কামাই করতো না। নতুন বন্ধু, নতুন শিক্ষক নতুন বই সব মিলিয়ে নিতুর ভালোই দিন যাচ্ছে। কখনোই স্কুলে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে হয়নি। সকাল সকাল নিজেই তৈরি হয়ে নিতো। কোনো সময় সর্দিকাশি হলেও স্কুলে না গিয়ে থাকতো না। উল্টো মাকেই বলতে হতো, শরীর ভালো না লাগলে আজ না হয় স্কুলে যেওনা।

তিন বছর তো গেলো। ইদানীং নিতুর মধ্যে এক অদ্ভুদ পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন মা নাসরিন বেগম। মেয়ে স্কুলে যেতে চাইছে না। কি হলো কিছুই বুঝতে পারছেন না কেউ। কিছুই বলছে না। জিজ্ঞাসা কললে বলে, এমনি। আমার ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে না বলে কি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে? নিতুর বাবা রফিক সাহেবও উদ্বিগ্ন। তার ধারণা, স্কুলে কেউ নিতুকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, যার কারণে নিতু স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে।

নিতুর স্কুলটাও খুব বেশি দূরে নয়। মাইল দুয়েক হবে। বাসার গলি হয়ে বড় রাস্তার মুখে আসতেই অনেক সময় লেগে যায়। তাছাড়া রাস্তায় সারাক্ষণ জ্যাম লেগে থাকে। নিদ্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়। ক্লাস থ্রি তে ওঠার পর স্কুল ভ্যানে করেই যাওয়া আসা করেছে নিতু। মা ভাবছে, নিতুকে স্কুল ভ্যানে কেউ কিছু বলেছে কি না।

রফিক সাহেব স্ত্রী নাসরিনকে বললেন, ক’দিন আমরাই মেয়েটাকে স্কুলে নিয়ে যাই। তাতে হয়তো মেয়েটা সাহস ফিরে পাবে। দেখি তাতে যদি স্কুলে যাওয়ার ভয়টা কাটে। যেদিন বাবার সাথে গেলো সেদিন রফিক সাহেব খেয়াল করলেন, নিতু বার বার দু’হাতে কান চাপা দিয়ে রাখছে। তাতে নিতুর কচি মুখে এক ধরণের বিরক্তির ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠছে। তাতে মনে হলো নিতুর খুব কষ্ট হচ্ছে। গাড়ির বিকট শব্দ, হর্ণের আওয়াজ, কালো ধোঁয়া এসব নিতুর সহ্য হচ্ছে না। শুধু নিতু নয়, স্কুলের সহপাঠিদের অনেকের কাছেই এটা একধরণের কস্ট। অসহ্য যন্ত্রণার।

রফিক সাহেব বুঝতে পারলেন, যখন জ্যামে থাকে কিংবা স্কুলে যাওয়া আসার পথে বিকট শব্দে গাড়ির হর্ণ বাজায় তখন সৃষ্টি হচ্ছে শব্দ দূষণ। কোমলমতি শিশুরা এটা সহ্য করতে পারছে না। এই ভীতিটাই নিতুকে পেয়ে বসেছে।

একদিন বাবার সাথে রিক্সা করে যাবার সময় নিতু দেখলো, তারই সমবয়সী একটা মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। নিতু অপলক তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। টুং টাং বেল বাজিয়ে মেয়েটা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর মিস্টি শব্দ। শব্দটা নিতুর কাছে বেশ ভালোই লাগছে। কোনো ধোঁয়া নেই। বড় গাড়িগুলো রাস্তা জ্যাম করে রাখে। তাতে সাধারণ মানুষের খুব কস্ট হয়। অথচ সবাই পরিবেশবান্ধব সাইকেল ব্যবহার করলে কত ভালো হতো। বিকট কস্টদায়ক শব্দ থাকতো না। বিরক্তিকর ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকা পড়তে হতো না। স্কুল থেকে ফেরার পর নিতু শুধু একথাগুলোই ভাবছে।

সেই রাতে নিতু ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি। যাও একটু চোখ বুজে এলো অমনি স্বপ্ন দেখলো বাংলাদেশের বড় ব্‌ড় শহরগুলোতে কোথাও বড় গাড়ি নেই। সব সাইকেল। শুধু সাইকেল আর সাইকেল। হরেক রকমের রঙিন সাইকেল। সবাই সাইকেল চালিয়ে যে যার মতো কাজ করছে। মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে অফিস করছে। বাজার করছে। ছাত্র ছাত্রীরা সাইকেল চালিয়ে স্কুল কলেজে যাচ্ছে। সারা শহরে কোনো জ্যাম নেই। শব্দদূষণ নেই। কোথাও কালো ধোঁয়া নেই। বিকট শব্দে কোথাও হর্ণ বাজছে না।

সারা শহরজুড়ে কেবল টুং টাং টুং টাং মিষ্টি একটা আওয়াজ। সবাই যেন একই সুরে গাইছে, আমরা সবাই রাজা। শুনতেও বেশ লাগছে। শহরটা কত সুন্দর পরিপাটি। সাজানো গুছানো। কোথাও কোনো ময়লা আবর্জনা নেই। শহরজুড়ে সরকারি নির্দেশে শুধু পরিবেশবান্ধব সাইকেল ব্যবহার করছে সবাই। একদিনে সারা শহরের চেহারাটাই কেমন যেন পাল্টে গেলো।

পরদিন ঘুম থেকে উঠেই নিতু ভাবলো, ইস! একদিনে শহরটা কত বদলে গেলো। মানুষ ইচ্ছা করলে কী না পারে? বাবার সাথে স্কুলে যাবার সময় বললো, বাবা, আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিও। আমি সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাবো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচুয়েটে এডভান্সড কম্পিউটেশনাল ম্যাটেরিয়াল্‌স রিসার্চ ল্যাব উদ্বোধন
পরবর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ