আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

‘ও আমার বাংলাভাষা রে/ তুই প্রথম। দিলি মুখে বুলি মা/ কারো সাথেই যার হয় না তুলনা/ তোর নাম হলো তাই মাতৃভাষা রে।’ ভাষা নেই এমন কোনো সৃষ্টি নেই। সে প্রাণবান হোক আর প্রাণহীন জড় হোক। ভাষা আছে বলেই যে কোনো প্রাণী, বস্তু ও পদার্থের রূপ ও প্রকৃতি সহজে চেনা যায়, বোঝা যায়। মানুষের যেমন ভাষা আছে তেমনি মাটি, আকাশ, বাতাস, পানি, পাথর, ফুল, পাখি, বৃক্ষ-লতা, জীব-জানোয়ার ইত্যাদি সকল কিছুরই নিজ নিজ ভাষা আছে। এই ভাষা এলাকাভিত্তিক, শ্রেণিভিত্তিক, জাতিভিত্তিক হয়ে থাকে। মানুষ এক কিন্তু জাতি বা এলাকা ভেদে ভাষা ভিন্ন ভিন্ন, তেমনি অবস্থান ভেদে মাটির ভাষাও পৃথক হয়ে যায়, যেমন মরু অঞ্চলের মাটির ভাষা আর নদী বা সাগর পাড়ের বা পর্বতের মাটির ভাষা এক নয়। এই ভিন্নতা সব সৃষ্টির ক্ষেত্রেই কমবেশি প্রযোজ্য। প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও সৃষ্টির অনাবিষ্কৃত রহস্যের মধ্যেই এর কারণ নিহিত। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। মানুষের সম্মিলিত প্রত্যাশা ও দাবির কাছে তা এক ফুকারে উড়ে যায়। এই দাবি যে কখন দানা বেঁধে ওঠে তা ঝানু রাজনীতিবিদদের হিসেব-নিকেষেও অনেক সময় ধরা পড়ে না।
যেমনটি ধরা পড়েনি একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সময়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত যখন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করলো তখনই প্রমাণিত হলো যে, তারা রাষ্ট্রীয় সরকার। ব্যবস্থা নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন। সে কারণে মানুষের ইচ্ছা ও তাদের দাবির প্রতি নেতৃবৃন্দের চিন্তা কম ছিল। সে কারণেই সর্বদলীয় এই সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নেয়নি ছাত্ররা। তারা আগে থেকেই মনে মনে প্রস্তুত ছিল ১৪৪ ধারা অমান্য করে তাদের দাবির তীব্রতা প্রকাশের জন্য। এই ১৪৪ ধারার ভাঙার সিদ্ধান্ত তখন গ্রহণ করেছিল।
তিনটি পক্ষ:সাধারণ ছাত্র ও কর্মীরা এবং ছাত্র নেতাদের কয়েকজন, পৃথকভাবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এসে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভায় এর যে প্রতিফলন ঘটেছিল তা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেই শুধু নয়, বাঙালি জাতির পরবর্তীকাল ও বর্তমানেও বাংলাদেশের যে কোন আন্দোলন সংগ্রামের জন্য প্রেরণাদায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের যে প্রস্তুতি ছাত্ররা ৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে চালাচ্ছিলেন, যে কর্মসূচি তারা গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল নিয়মতান্ত্রিক। বরঞ্চ মুসলিম আওয়ামী লীগ ও গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টি চেষ্টা করেছিল এই আন্দোলনের রাশ নিয়ন্ত্রণ করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করতে। কিন্তু তাদের চিন্তায় ভুল ছিল। তারা অনুধাবন করতে পারেননি মানুষ বিস্ফোরণের জন্য কী রকম উন্মুখ হয়ে আছে। ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ফজলুল হক হল আর ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) মাঝখানের পুকুরপাড়ে রচিত হয়েছিল আরেক ইতিহাস। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যে কোন মূল্যেই হোক, ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। এবং তার জন্য কতগুলো কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করলে তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরুদ্ধে মত দিতে পারেন এবং তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে, তাই গাজীউল হককেই আমতলার সভায় সভাপতিত্ব করতে হবে। তিনি যদি সভার আগেই গ্রেপ্তার হয়ে যান এম আর আখতার মুকুল সভাপতিত্ব করবেন, তিনি গ্রেপ্তার হলে কমরুদ্দিন শহুদ সভাপতিত্ব করবেন। সেদিনের সেই ঘটনা বিশদভাবে উঠে এসেছে বশীর আল হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে। সেখানে পুকুরপাড়ের সেই বৈঠকের বর্ণনা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবসন্ত এসে গেছে
পরবর্তী নিবন্ধশহরটাকে সবাই নিজের মনে করুক