অতিরিক্ত প্রাপ্তি, বেঁচে থাকার আনন্দ ও ব্যক্তিক মর্মবেদনা

ছন্দা দাশ | বৃহস্পতিবার , ১০ জুন, ২০২১ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

যাঁরা সমাজের বা মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে ভাবেন তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন আজকের যুব সমাজের একটা বিশাল অংশ হতাশার শিকার। এই চিত্র পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। দশ বছর আগেও আমি আমাদের সন্তানদের মধ্যে এই পীড়ন লক্ষ্য করিনি। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!
আমি কোন সমাজতত্ত্ববিদ নই, কোন রাজনীতিবিদও নই। আমি মায়ের চোখেই দেখি আমাদের সন্তানদের এই নিরাসক্ত জীবনের প্রতি মনোভাব। যে হাতে একজন মা তার সন্তানকে দোলনায় দোলাতে দোলাতে বড় করে ভবিষ্যৎ দেশনায়ককে সেই মা-ই তো দেখতে পায় তার সন্তানের মর্মবেদনা।
কিন্তু সত্যিই কি দেখবার সময় তাঁদের হচ্ছে? তার আগেই আমরা সন্তানের ভবিষ্যত নির্ধারণে এতো বেশি তৎপর আসল জায়গার ফাঁক দেখতেই পাচ্ছি না। আগে আমাদের পিতামাতা তাদের সন্তানকে শুধুমাত্র লেখাপড়া এবং চরিত্র গঠনের জন্যে কঠোর শাসন করতেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি যে এখনকার অভিভাবকেরা এতোবেশি তাঁদের উত্তরাধিকারীর প্রতি উদ্বিগ্ন শুধুমাত্র শিক্ষায় যথেষ্ট নয়, তাদের জন্য, বাড়ি (একাধিক) গাড়ি, ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের টাকা, সম্পদের ব্যবস্থা করে যান যাতে কখনও তাকে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়। আমার জানা এমন অনেক অভিভাবককে দেখেছি ঢাকা, চট্টগ্রাম মিলিয়ে তিন, চারটি ফ্ল্যাট ছেলের জন্য রেখেছেন, অথচ ছেলে নিজেও বাড়ি করেছে দুখানা। ছেলেকে বলেছেন আমাদের কথা ভাবতে হবে না। তুমি নিজের জীবন গুছিয়ে নাও। একজন মানুষের জন্য এতে প্রাচুর্য সত্যিই কী তাকে আনন্দ দিতে পারে? যেমন দিনশেষে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত শ্রমিক মোটা চালের একথালা ভাত পেয়ে তার মুখের সেই আনন্দের মতো?
আমাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে এখন শুধু নিজের জন্য। তার থাকে না বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভাল করার দায়, ছোট ভাই -বোনদের মানুষ করার দায়।তারা জানে না তাদের কর্তব্য। ওরা শুধু নিতে শিখেছে। এমনকি পেতে পেতে পাওয়ার আনন্দও ওরা জানেনা কেমন।কারণ ওরা মনে করে এটা তাদের প্রাপ্য।
আমি এমন একজন অভিভাবককে জানি নিজে ভীষণ কষ্ট করে বড় হয়েছেন। এই যে সংগ্রাম তা তাঁকে দিয়েছে আনন্দ, তৃপ্তি সফল মানুষ হবার পরে। কিন্তু তিনি ভুল করেছেন নিজের সন্তানের বেলায়। তাঁর বক্তব্য এই যেহেতু আমি কষ্ট করে বড় হয়েছি তাই আমি আমার সন্তানকে কষ্ট পেতে দেব না। অথচ তিনি মনে মনে চাইতেন তাঁর ছেলে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুক। কিন্তু ছেলে কষ্ট কি তাই জানে না। বরং তার সম্পদের উপর একধরনের নিরাসক্ততা তাঁকে আহত করে।
আমি এতক্ষণ যেসব কথা বললাম তা পড়ে আপনাদের মনে হতে পারে এসবের জন্য আমাদের প্রজন্মই দায়ী। সত্যিই কি তাই? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে আমাদের কৃতকর্মের শিকার ওরা। আমরা নিজের সুখের আশায় যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে একক পরিবারের অসুখী আবহাওয়ায় ওদের বড় করতে গিয়ে ওদের নিজেদের আনন্দের সাথে সাথে গলা টিপে মেরেছি ওদের আনন্দময় জগতটাকে। ওরা একদিকে বঞ্চিত হয়েছে দাদা-দাদী, নানা-নানি, ভাই-বোনদের সাথে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে ভাগ করার শিক্ষা থেকে অন্যদিকে বঞ্চিত হয়েছে পিতা -মাতার নিবিড় মমতা থেকেও। বর্তমান সময়ে নারীরা শুধুমাত্র গৃহিণী হয়ে থাকতে নারাজ। মানুষ হিসেবে তার নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিতি কে না চায়?এতে কারো দ্বিমত থাকা উচিতও নয়। কিন্তু কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তানদের আলাদা মনোজগতের খবর অনেকেরই জানা নেই। এসব বাবা-মায়ের মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করে সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না বলে। সেই অভাবটা তাঁরা পূরণ করতে চান নিত্য নতুন দামী জিনিস উপহার দিয়ে। প্রথম প্রথম সন্তানেরা খুশি হয় ঠিকই কিন্তু একসময় তারা ঠিকই বোঝে কেন এই ভালোবাসার প্রাবল্য। তারা তখন হারিয়ে ফেলে পাওয়ার আনন্দকে। তার বদলে একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর জীবনের প্রতি ওদের আসে নৈরাশ্য।এদের অনেককেই আমি দেখেছি ড্রাগে আসক্ত হতে। কিছুদিন আগেও জঙ্গি দলের যুবকদের বেশিরভাগই আসতে দেখেছি অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে।এদের প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতি কোন আগ্রহ থাকে না। আমি জানি অনেকেরই মনে প্রশ্ন তাহলে কি নারীরা চাকরি করবে না? সন্তান মানুষ করা এককভাবে কি শুধু নারীর দায়িত্ব? এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে আমাকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে হয়। কিন্তু একথা সত্যি যে নারী যখন মা হয় অবধারিত ভাবেই তার কাঁধে এসে পড়ে সন্তানকে মানুষ করার অলিখিত দায়িত্ব। কাজেই আপনি সন্তান নেবার আগে ভেবে দেখা উচিৎ আপনি মা হবার উপযুক্ত কি না! মা হবার পরে আপনি কতটুকু সময় সন্তানের জন্য ব্যয় করতে পারবেন? নারী একসময় অশিক্ষিতা, স্বল্প শিক্ষিতা,পর নির্ভর, অসচেতন এবং প্রতিবাদহীন ছিল। সময়ের বদলে নারী তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে সত্যি। কিন্তু তার প্রেক্ষিতে তাকে দিতে হচ্ছে কঠোর মূল্য। আমি এমন অনেক নারীকে জানি শুধুমাত্র অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য দ্বিতীয়বার সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। কর্মজীবনে তিনি সফল কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তান প্রাচুর্যের মধ্যে শুধু হতাশাকেই লাভ করেছেন।
এসব তথ্য কমবেশি সবার জানা, সবাই বোঝেন। তবুও তো আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে উপেক্ষা করে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছি খাদের সীমান্তে।
আমাদের ছোটবেলায় আমরা দেখতাম বড় ভাই বা বোনটিকে অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। কেননা তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হতো সংসারের কর্তা ব্যক্তিটির অবর্তমানে তাকেই হতে হবে কাণ্ডারী। কাজেই তার শিক্ষা, তার আচার আচরণ, তার চলাফেরা এমন হতে হবে যা ছোটদের হবে অনুসরণীয়। বড়ো সন্তানটিও তাই জীবনের একটা লক্ষ্য স্থির রেখে নিজের জীবনকে গড়ে তুলতো। এতে সে তার জীবনের যথার্থতা খুঁজে পেত। কিন্তু আমি খুব দুঃখের সাথে হৃদয়ঙ্গম করছি একালের যুব সমাজ তার জীবনের উদ্দেশ্যই খুঁজে পায় না। শুধু পারিপার্শ্বিক জীবনকে ভুলে ইঁদুর দৌড়ে ভালো রেজাল্ট করবে শেষে প্রচুর উপার্জন করে একটা বিলাসী জীবন নিয়ে খাঁচাবদ্ধ পাখির মতো জীবন কাটাবে -এটা কখনোই মানুষকে সুখী করতে পারে না। কেউ কেউ বলে থাকেন অর্থবান লোক অর্থের কাঙাল। সে আরও অর্থ উপার্জনে সবসময় লালায়িত থাকে। প্রকৃত অর্থে এছাড়া তার আর অন্য কোন পথ নেই। কারণ এই জীবনের জন্য সে তার সমস্ত ভালো লাগার পথগুলো বন্ধ করে এসেছে। এখন আর তার সেই জীবনে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। তাই সে ভুল পথেই বারবার সুখ খুঁজে ফিরে।
আমরা আমাদের যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়েছি সুখের জন্য, আবার সেই পরিবারে সন্তান সংখ্যা সীমিত করতে করতে একজনে এসে ঠেকেছে। উপায়ও নেই। নিজের কর্মজীবন, অর্থনৈতিক অবস্থা, লোকবলের অপ্রতুলতা। এ ছাড়াও উন্নত বিশ্বের জীবনযাত্রায় প্রভাবিত আমরা শিশুকে আলাদা করে দিচ্ছি স্বনির্ভর হবার জন্য। তার ভালো খারাপ দুটো দিকই আছে। তার আগে চলুন আমি আমাদের শৈশবকালীন দিনগুলোতে ঘুরে আসি। আমাদের সাত ভাইবোনদের মধ্য শুধু বড়দি ছাড়া আর কারো পড়ার টেবিল ছিল না। সকালে বা সন্ধ্যায় সবাই বড় টেবিলে একটি মাত্র লণ্ঠনের আলোতে বসে পড়তে গিয়ে আলো নিয়ে টানাটানি নিত্যকার ঘটনা।কিন্তু পড়তে পড়তে ভুল শব্দ উচ্চারণ বা অংক ভুল করলে বড়দি ঠিক করে দিয়েছেন সাথে সাথে। না পড়ে পালাবার কোন পথ নেই। বড়দি আছেন। কোন দুষ্টুমি বা খারাপ আলোচনা ভাবতেই পারিনি। আর অলিখিত ভাবে অন্যের প্রয়োজন, সুবিধা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধও গড়ে উঠেছে যা পরবর্তী জীবনে হয়েছে সহায়ক। এই সেদিনও দেখেছি এই প্রজন্মের স্কুল পড়ুয়া ছাত্র মা নক্‌ না করে রুমে ঢুকেছে বলে মায়ের সাথে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করলো।এ কেমন অগ্রগতি বা ভদ্রতা আমি বুঝতে অপারগ। রুম বন্ধ করে সে কি এমন করছিল যাতে মা নক্‌ না করে ঢুকলে সে অপমানিত বোধ করে? একটু ভাবলেই বুঝতে কষ্ট হবে না এ আমাদের পশ্চিমা রীতি অনুসরণ করার কুফল। প্রতিটি কাজের ভালো মন্দ দুটো দিকই রয়েছে। আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ কোন পথ অবলম্বন করলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম মানুষ হবে। যা ওদের জন্য হিতকর তা আমাদের জন্য বিষতুল্য হতে পারে। আমরা বিশ্বের সাথে একাত্ম হতে গিয়ে নিজের রক্তকে ভুলে যাবো এ হতে পারে না। শেষ করবার আগে একটিবার বলতে চাই আমরা আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা এখন নত হয়ে আছি ভার্চুয়াল জগতের দিকে। যা কিছু দেখি, যা কিছু জানি সব ভার্চুয়ালি। আসলটা বহু সুদূরে। তাই যা কিছু সৃষ্টি তাতে সৃষ্টির গৌরব আছে বটে প্রাণের পরশ নেই। আগামীতে এক বিশাল কৃত্রিম পৃথিবীতে মাথা নত করা মানুষেরা থাকবে। যারা তার চারপাশের জগতের খবর জানবে না।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধলক্ষ্মী নামের মেয়েটি
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থনৈতিক গতিধারায় আধুনিক অর্থনীতির ক্রমবিকাশ