৯ অক্টোবর ২০২৫ মিশরের শরম আল শেখ এ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত ২০ দফা গাজা শান্তিচুক্তি “ ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার” স্বাক্ষরিত হয়। এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে আমেরিকা ঘেষা রাষ্ট্র তথা সরকার প্রধানরা সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, এটি আমার পূর্বের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ শান্তি চুক্তি এক পক্ষের (প্যালেস্টাইনীদের) উপর চাপিয়ে দেওয়া এবং অন্য পক্ষ (ইসরাইলীদের) কে যাবতীয় সুবিধাদানের বিষয়গুলিও আমার পূর্বের লেখায় আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। এসব বিবেচনায় রেখে গাজা শান্তি চুক্তির অগ্রগতি এবং শিরোনামে প্রকাশিত সংশয় নিয়ে বর্তমানের আলোচনা।
শান্তিচুক্তির পর গাজায় প্রতিদিন খাদ্যবাহী ৬০০ (ছয়শত) ট্রাক প্রবেশ করার কথা এটি হয়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে যেটি জানা গেছে তা হল চুক্তি পরর্বতী এ পর্যন্ত মাত্র হাজার খানেক খাদ্যবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে।
লক্ষ লক্ষ টন ধ্বংসস্ত্তুপ সরানোর জন্য যে ভারী যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা প্রবেশে ইসরাইলীরা এখনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে নলকূপ বসানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রবেশ করতে অনুমতি প্রদানে ইসরাইল এখনও গড়িমসি করে চলেছে। একই অবস্থা বিদ্যমান বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ ব্যবস্থাতেও।
৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের ঘটনা পরম্পরায় ১৩ অক্টোবর ২০২৩ সালে ইসরাইল গাজার উপর বর্বর অমানবিক হামলা পরিচালনার পর থেকে ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা অনুযায়ী ইসারাইল গাজার উপর এ পর্যন্ত ২ (দুই) লক্ষ টনের অধিক বোমাবর্ষণ করেছে। এই বর্ষিত বোমার প্রায় চল্লিশ লক্ষ টন অবিস্ফোরিত রয়েছে যা গাজায় স্ব স্ব বাড়ি ঘরে ফিরে আসা মানুষদের জন্য বর্তমানে একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে উঠেছে। অবিস্ফোরিত বোমা সমূহ নিস্ক্রিয়করণে বা বিস্ফোরণ ঘটানোর উদ্যোগ গাজায় এখনও পরিলক্ষিত হয়নি।
এ ছাড়াও গাজার লক্ষ গৃহহীন মানুষের মাথা গোজার টাঁই যোগাতে এখনও কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। আপদকালীন আশ্রয়ের প্রয়োজনীয় তাবু সরবরাহেও তেমন কোন কার্যকরী উদ্যোগ এ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।
ইতিমধ্যে বরং যেটি শংকার এবং যেটি এ পর্যন্ত বিশ্ব সম্প্রদায়কে ভ্রুকুটি না করার ঔদ্ধত্য ইসরাইল দেখিয়ে এসেছে তার পুনরাবৃত্তি করেছে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, সেটি হল শান্তিচুক্তি বলবৎ এবং যুদ্ধবিরতি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় এসব ভঙ্গ করে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীকে গাজায় ভারী আক্রমণ পরিচালনার পুনঃনির্দেশ।
একই সাথে সাম্প্রতিকের ইসরাইলী পার্লামেন্টে পশ্চিমতীরকে ইসরাইলের সাথে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব গাজা তথা প্যালেস্টাইনে শান্তি স্থাপনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দেবে এতে কোন সন্দেহ নাই। অতীতের অসলো শান্তি চুক্তির দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির জন্য ইসরাইলের দখলদারিত্বমূলক মনোভাবই প্রধানতম কারণ ছিল। অসলো চুক্তির বিষয়টি এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা সমীচিন তবে তার পূর্বে ‘এ্যালোন পরিকল্পনা’ নিয়ে এখানে কিছুটা আলোকপাত করলে ইসরাইলের ঐতিহাসিক আগ্রাসী মনোভাব এবং দখলদারিত্বের অসৎ উদ্দেশ্য পাঠকদের কাছে স্পষ্টত প্রতিভাত হবে।
১৯৬৭ সালে আরব–ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল আরবদের বিশাল ভূখণ্ড দখল করে নেয়। এর মধ্যে:- জর্ডানের – পশ্চিম তীর যার মধ্যে জেরুজালেম অন্তর্ভুক্ত, মিশরের – গাজা এবং সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার – গোলাইন হাইট।
এ্যালোন, একজন ইহুদি– ইসরাইলী রাজনীতিবিদ, তিনি তার পরিকল্পনায় প্রস্তাব করেন, পশ্চিমতীরকে জর্ডান এবং ইসরাইলের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, যার মাঝে জেরুজালেমকে দ্বি–খণ্ডিত করার প্রস্তাবও ছিল। সিনাইকে মিশরের কাছে প্রর্ত্যাপণ এবং সিরিয় গোলান হাইটকে ভিত্তি করে দ্রুজদের জন্য স্বতন্ত্র একটি আবাসভূমি সৃষ্টি। উল্লেখ্য সিরিয়ায় প্রায় ৬,০০,০০০ (ছয় লক্ষ)এর অধিক দ্রুজদের বসবাস, লেবানন এবং ইসরাইলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দ্রুজদের বসবাস রয়েছে। এই দ্রুজরা নিজেদের ইব্রাহিম (আঃ) অনুসারী দাবী করে এবং এরা একেশ্বরবাদীও। ‘এ্যালোন পরিকল্পনা’ বাস্তবায়িত হয়নি, তবে পশ্চিমতীরকে ঘিরে ইসরাইলী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এখনও যে চলমান তার প্রমাণ সাম্প্রতিকের ইসরাইলী পার্লামেন্টে পশ্চিমতীরকে ইসরাইলের সাথে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব।
এবার দৃষ্টি ফিরাই ‘অসলো শান্তি চুক্তি’র দিকে। অসলো চুক্তি জাতিসংঘ প্রস্তাব ২৪২ এবং ৩৮৩ কে ভিত্তি করে প্রণীত হবার পথ খুঁজে নেয়। এই পথরেখা ধরে প্রথম অসলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। দ্বিতীয় অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৫ সালে। প্রথম অসলো চুক্তির মৌল উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে ভবিষ্যৎ শান্তি স্থাপনে সরাসরি একটি যোগাযোগ স্থাপন এবং বিদ্যমান সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করার রূপরেখা প্রণয়ন।
প্রথম অসলো চুক্তিতে ইসরাইল – প্যালেস্টাইন দ্বি রাষ্ট্র গঠন বিষয়টি স্বীকৃত হয়। এতে পশ্চিমতীর এবং গাজা’কে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখিত হয়। এসবের বিনিময়ে প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করে, সন্ত্রাসবাদকেও নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়।
দ্বিতীয় অসলো চুক্তিতে দুই পক্ষের সীমানা, শরণার্থী এবং জেরুজালেম এর অবস্থান নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয় বিবৃত হয়।
এতসব সত্ত্বেও অসলো চুক্তি সফলতার মুখ দেখেনি।
অসলো চুক্তি’র ব্যর্থতার পিছনে অন্যতম কারণ হিসাবে ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান প্যালেস্টাইনী ভূমির জবর দখলকে দায়ী করা হয়, একই সাথে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর আততায়ীর হাতে নিহত হওয়াকেও অনেকে আরো একটি কারণ হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন।
এবার আসি ‘ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার’ চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার সন্দেহ উদ্রেককারী বিষয় সমূহ আলোচনায়। যেমন:
শান্তিচুক্তি বলবৎ এবং যুদ্ধবিরতি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর সেদেশের সামরিক বাহিনীকে গাজায় ভারী আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ। ইসরাইলী পার্লামেন্টে পশ্চিমতীরকে ইসরাইলের সাথে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব। চুক্তির ১৫ নাম্বার ধারায় বলা আছে ‘আমেরিকা– আরব এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী আই এস এফ (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স) গঠন হবে’। এখন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দম্ভ ভরে ঘোষণা করছে গাজায় কোন দেশের সৈন্য মোতায়েন হবে সেটি ইসরাইল নির্ধারণ করবে।
চুক্তির ৯ নাম্বার ধারা অনুযায়ী গাজা পুনঃগঠনের জন্য ‘দি বোর্ড অব পিস’ নাম দিয়ে একটি সংস্থা গঠন করা হবে। এই বোর্ডের প্রদান হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এই বোর্ডে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদেরও মনোনয়ন দেওয়া হবে। এই বোর্ড গাজার উন্নয়ন সাধন, পৃথিবীর যেকোন উন্নত শহরের মত প্রশাসনিক এবং আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করবেন। কিন্ত্তু দুর্ভাগ্য এবং পরিতাপের বিষয় যে আমেরিকার অর্থ আর অস্ত্র বলে ইসরাইল গাজা’র উপর নির্মম ধ্বংস আর হত্যালীলা চালায়, সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গাজা পুনঃগঠনের প্রধান এটা ইতিহাসের পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়।
চুক্তির ১৩ নাম্বার ধারায় উল্লেখিত আছে ‘গাজার সকল প্রকার সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রপাতি, টানেল ধ্বংস করা হবে। গাজাকে সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে বিদ্যমান অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজনে ক্রয় করা হবে’ পরিহাস ইসরাইলে যাবতীয় মারণাস্ত্র সম্পর্কে বা গাজার হত্যা যজ্ঞ সম্পর্কে কোথাও একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি।
উপরের সব কিছু বিবেচনায় নিলে একথা বলা যায় বা উপসংহারে আসা যায় গাজার জন্য প্রণীত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর গাজা শান্তি প্রস্তাব ‘ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার’ শিরোনামের ২০ দফা প্রস্তাবও কি তাহলে অসলো চুক্তির ভাগ্যবরণ করতে চলেছে?
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।








