আজ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। জাতীয় সংস্কৃতির গৌরবময় বিকাশকে অব্যাহত রাখতে ১৯৭৪ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি এই একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চার একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় শিল্পকলা একাডেমির শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রত্যেক জেলায় একজন কালচারাল অফিসার রয়েছেন, যিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। বর্তমানে এর কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত।
শিল্প সংস্কৃতির বিস্তার ও দেশব্যাপী গুণী শিল্পীদের মূল্যায়নের ব্যাপারে শিল্পকলা একাডেমির ভূমিকা অপরিসীম। নিয়মিত অনেক কর্মকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : গুণী ও প্রতিভাবান শিল্পীদের সহায়তা ও স্বীকৃতি প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে অনুদান প্রদান, অতীত ঐতিহ্য ও সমকালীন সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা এবং সঙ্গীত, নাট্য ও চারুকলা বিষয়ে আন্তর্জাতিক উৎসবাদির আয়োজন। এখানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে উৎসব, সম্মেলন, সেমিনার, নাট্যানুষ্ঠান ও কর্মশালা আয়োজন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চিত্রকলা প্রদর্শনী, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পুরস্কার প্রদান, বিদেশে সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক দল প্রেরণ এবং বিদেশী সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো, দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত করা এবং শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গ্রন্থ, সাময়িকী ও স্মরণিকা প্রকাশ ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।
আমরা জানি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবারিত চর্চার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায় সভ্যতা, এগিয়ে যায় দেশ। যে সমাজে সংস্কৃতির চর্চা অনুপস্থিত, সেখানে মেধা থাকে অবরুদ্ধ, সুন্দর হয় তিরোহিত। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মতে, সৃজনশীল মানুষরা আছেন বলেই আজও আমরা সুন্দরের স্বপ্ন দেখি। দেশে সুস্থ সংস্কৃতির ধারাকে বেগবান করার ক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে জাতির শিল্প-সাহিত্যে চর্চা হয় না, যে জাতি নিজেদের শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে পারে না সেই জাতি দুর্ভাগা জাতি। শিল্পকলার ইতিহাস হলো বিজ্ঞান ও শিল্পের একটি বহুশাস্ত্রীয় শাখা। বিংশ শতাব্দীতে শিল্পকলার প্রধান শাখা হিসেবে নয়টি বিদ্যাকে চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো হলো স্থাপত্য, নৃত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, কাব্য, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি ও গ্রাফিক আর্ট। বাস্তবতা হলো এ সকল শিল্পকর্মের সঙ্গে সকলেই যুক্ত থাকেন না। কিন্তু যুক্ত থাকা জরুরি। মানুষ একান্তই অনুকরণপ্রিয়। অনুসরণ প্রিয়। কেউ যদি এর চর্চা করেন, তার দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসেন। শিল্পীর সঙ্গে সংস্পর্শে শিল্প-মন তৈরি হয়। পরে শিল্পকর্মের দায়িত্ব ও ভূমিকা বাস্তব রূপের প্রতিফলন ঘটে।
আমাদের সবাইকে বাঙালি সংস্কৃতি তথা দেশীয় সংস্কৃতিচর্চা করা উচিত। সবাই কবি, সাহিত্যিক বা শিল্পী হতে পারে না। কিন্তু মানবিক সমাজ তৈরি হতে হলে আদর্শ সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজন আছে। এভাবে সৃজনের প্রেরণায় শিল্পসংস্কৃতি জীবনের দায় হয়ে যায়। নন্দন ও মানবিক দায় একই সূত্রে কার্যকর হতে থাকে। তবে সব শিল্পীর কাজ সম্পর্কে একথা প্রযোজ্য নয়। শিল্পের জন্য শিল্পতত্ত্বও এক সময় চর্চা হয়েছে। এখন জীবনের জন্য শিল্প। যে শিল্প জীবনকে সাজাতে ও জাগাতে মুখ্য উপায় হিসেবে কাজ করে থাকে। মানবসভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের প্রবাহ এগিয়ে যায় সৃষ্টির আনন্দে। এই সৃজনধারা শুধু যে আনন্দ ও সৌন্দর্য দান করে তা নয়; জীবন ও জগতকে নতুন আলো দেখায়, শুভবোধে উদীপ্ত করে, কল্যাণব্রতে প্রেরণা জোগায়, প্রাণ জাগাতে ও সমাজ বিনির্মাণে উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করে। এককথায় জীবনের জন্য নান্দনিকতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টিতে তা অনন্য।
জেলায় জেলায় শিল্পকলা একাডেমির নানা উদ্যোগের কারণে বর্তমানে শিল্পকলার দেশব্যাপী চর্চা, প্রসার ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে। তাই একাডেমিকে ঘিরে যে রকম শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা চলে, তার পরিধি আরো বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লালন ও বিকাশের লক্ষ্যে এই একাডেমি আগামীতেও তার কার্যক্রম সনিষ্ঠ আন্তরিকতায় অব্যাহত রাখবে- সেই প্রত্যাশা আমাদের।