বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের গতি দ্রুত। সড়ক, সেতু, রেললাইন, সমুদ্রবন্দর ও নগরায়নের বিস্তার–সব মিলিয়ে এক নির্মাণ–তৎপর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই উন্নয়ন কি পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, যেখানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ক্রমাগত ঝুঁকির মুখে, সেখানে এই প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, পরিবেশবান্ধব ও প্রযুক্তিনির্ভর নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের সময় এসেছে। পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি) সেই উত্তরের একটি অন্যতম অংশ হতে পারে। এটি শুধু শক্তিশালী নির্মাণ উপকরণই নয়, বরং জলবায়ু অভিযোজন ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্যও কার্যকর। পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি) মূলত একধরনের ব্লেন্ডেড সিমেন্ট। এটি তৈরি হয় অডিনারি পোর্টল্যান্ড ক্লিংকার, জিপসাম এবং গ্রাউন্ড গ্রানুলেটেড ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ (জিজিবিএফএস)-এই তিন উপাদান মিশিয়ে। জিজিবিএফএস হলো লৌহশিল্প থেকে প্রাপ্ত উচ্চতাপে গলিত ধাতব বর্জ্য, যা দ্রুত ঠান্ডা করে গুড়ো করে পুনর্ব্যবহার করা হয়।
প্রচলিত অডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের (ওপিসি)-এর তুলনায় স্ল্যাগ সিমেন্ট ব্যবহারে প্রতি টনে ৮০ থেকে ১০০ কেজি কার্বন কম নিঃসরণ হয়। কারণ স্ল্যাগ সিমেনে ক্লিংকারের ব্যবহার কম, যা সিমেন্ট শিল্পে সবচেয়ে বেশি কার্বন–নির্গমনকারী উপাদান।
জিজিবিএফএস –এর গ্লাসি মাইক্রোস্ট্রাকচার স্ল্যাগ সিমেন্ট কে করে তোলে কম ব্যাপ্তিযোগ্য, সালফেট ও ক্লোরাইড প্রতিরোধী। ফলে এটি উপকূলীয় অঞ্চল, জলমগ্ন নির্মাণ, ও রাসায়নিকভাবে আক্রমণাত্মক পরিবেশে অধিক স্থায়িত্বশীল। স্টিল বা রডে জং ধরার হারও অনেক কম হয়। তাই, ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা ও পানির অনুপ্রবেশে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকার স্থাপনা নির্মাণে স্ল্যাগ সিমেন্টই উপযুক্ত উপকরণ।
স্ল্যাগ সিমেন্ট–ভিত্তিক কংক্রিট অডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের (ওপিসি)-এর তুলনায় ২০–৩০% বেশি স্থায়িত্ব দেয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কম হয়, যা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত–দু’দিক থেকেই লাভজনক। ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে পিসিআই একটি কার্যকর প্রতিরোধক। এর কম হাইড্রেশন তাপ বৈশিষ্ট্য কংক্রিটে তাপীয় ফাটল প্রতিরোধ করে, যা উপকূলীয় বাঁধ, ব্রিজ, জলাধারসহ মেগা স্ট্রাকচারে গুরুত্বপূর্ণ।
মোদ্দা কথা, স্ল্যাগ সিমেন্ট কংক্রিটকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তোলে। এটি ওপিসির মতো জল ও রাসায়নিকের সাথে বিক্রিয়া করে একটি শক্ত বন্ধন তৈরি করে, যার ফলে কংক্রিটের ঘনত্ব বাড়ে এবং ফাটল বা ক্ষয় কম হয়। দীর্ঘমেয়াদে কংক্রিটের আয়ু বাড়ায় এবং পরিবেশবান্ধব, কারণ এটি বর্জ্য (ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ) উপাদান থেকে তৈরি ফলে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমন কমায়; শক্তি সাশ্রয় করে; পরিবেশে কম প্রভাব ফেলে; কংক্রিটের হালকা রঙের মাধ্যমে তাপ কমায়।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ২১.৮% কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে নির্মাণ খাত থেকে দেশের প্রায় ১৫–১৮% কার্বন নিঃসরণ হয়, সেখানে পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট (পিএসসি)-এর ব্যবহার এই লক্ষ্য পূরণে বড় অবদান রাখতে পারে।
বিশ্বে এখন ‘গ্রিন সিমেন্ট’ নামক ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছে, যার প্রধান উপাদান হলো জিজিবিএফএস, ফ্লাই অ্যাশ বা রাইস হাশ অ্যাশের মতো শিল্প বর্জ্য। পোর্টল্যান্ড স্ল্যাগ সিমেন্ট ইতিমধ্যেই এই সব কনসেপ্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বিকল্প। স্ল্যাগ সিমেন্টের ব্যবহার বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে: যেমন, সরকারি নির্মাণ কাজে পিএসসি বাধ্যতামূলক করা, বিএসটিআই মানদণ্ডে পিএসসি–এর বিশেষ উল্লেখ ও মাননির্ধারণ, মানদণ্ডের উপযোগিতা অন্তর্ভুক্তি, স্লাগ আমদানি শুল্ক হ্রাস ও দেশীয় প্রক্রিয়াকরণ উৎসাহ ও উদ্যোগ, স্থপতি, প্রকৌশলী ও নির্মাণকর্মীদের জন্য পিএসসি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, গ্রিন রেটিং সিস্টেম /এলইইডি বা ইডিজিই)-এ পিসিআই ব্যবহারে পয়েন্ট সংযোজন।
পরিবেশগত টেকসইতা ও জলবায়ু অভিযোজনের যুগে স্ল্যাগ সিমেন্ট একটি সময়োপযোগী প্রযুক্তি। এটি শুধু শিল্প বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই এবং নিরাপদ অবকাঠামোর ভিত্তিও গড়ে দেয়। এখন সময় এসেছে–সিমেন্ট বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু দাম নয়, তার প্রভাব, পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত মান বিবেচনা করার। কারণ নির্মাণ শুধু দেয়াল বা সেতু নয়–এটি ভবিষ্যতের ভিত্তি–প্রজন্মের জন্য এক টেকসই পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি।
লেখক : প্রকৌশলী, সিনিয়র ম্যানেজার –ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড