গান্ধীবাদী দর্শন ও আমাদের রাজনীতি

রিজোয়ান মাহমুদ | মঙ্গলবার , ৩১ মে, ২০২২ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

একসময় রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ও দুর্বলতা ছিল। মনে এক অফুরন্ত ভাবনা ও প্রশ্ন ছিল যে, রাজনীতি দিয়ে দেশ পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখা য়ায়। রাজনীতিকে যদি মনে করি রাজার নীতি তাহলে সামনে এসে দাঁড়ায় প্রজা সাধারণ। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসের যে রাজার নীতি, দুর্বল প্রজাসাধারণের কাছ থেকে কর আদায়ের যে কঠোর অনুশাসন, বেত্রাঘাত কিংবা বলা চলে কর দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জমি কেড়ে নেওয়া এসমস্ত বিষয়ে দুটো শ্রেণীকে আমরা দেখতে পাই। এক রাজার অপশাসন অপর দিকে গ্রামেগঞ্জে বেড়ে ওঠা নিষ্পেষিত দরিদ্র শ্রেণি। পিঠে চাবুক মারা অথবা দোররা মারার সংস্কৃতি বড় বেদনারবড় যন্ত্রণার। আজও উদাহরণ হিসেবে সেসবের ফিরিস্তি দিতে হয়। সেই রক্তের উত্তরাধিকারে আমাদের আধুনিক সমাজের আধুনিক পুঁজি সর্বস্ব রাজনীতি। রাজনীতি বলতে এখনও পীড়ন দমন গুম হত্যা অবিচারের দাসখত লিখে দেওয়া। রাজার শাসনের অব্যবহিত পরে আমরা ভারত বর্ষে সিভিল শাসন দেখেছি।

লালবাহাদুর শাস্ত্রী, মহাত্মাগান্ধী, জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী। এবঙ্গে আমাদের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সহোরোয়ারর্দি, এক এম ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এঁরা সবাই দীর্ঘ দিনের চর্চার ভেতরে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রজ্ঞার অধিকারী রাজনৈতিক দার্শনিক। ভারত বর্ষের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আইন বিষয়ে বিস্তর ধারণা থাকতে হতো সে সময়ে। রাজনীতি যেহেতু একটি নীতি বা লক্ষ্য নিয়ে আগাতে থাকে সে কারণে নীতির সঙ্গে আইনের সম্পর্কের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। আমার এই লেখার সঙ্গে এবং উপমহাদেশের এই রাজনীতির সঙ্গে গান্ধীবাদী রাজনৈতিক সম্পর্কসূত্র তৈরি করে দিলে রাজনীতি এতো তাড়াতাড়ি শুদ্ধ হয়ে যাবে না। যা হওয়া দরকার তা হলো রাজনীতিবোধ প্রীতিবোধ এবং সংস্কৃতিবোধ। তবে, গান্ধীর ত্যাগ তিতিক্ষা, অপরিসীম ধৈর্য্য, কল্যাণবোধ আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির মধ্যে যে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদদের গান্ধীর কথা বলতে অথচ এই স্বদেশপ্রেমী তপস্য মহাপুরুষকে অনুসরণের পথে এগুতে চায় নি তেমন কেউ। মহাত্মা গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৯ সালের ২, অক্টোবর, ভারতের পরানবন্দরে। এই মহাপুরুষকে উদাহরণে আনা যেতে পারে ছোটখাটো একটি গল্প দিয়ে। তাঁর জীবনেরই গল্প। গান্ধীজী ১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তখন সেখানে বাস করতেন প্রায় দুলক্ষ ভারতীয় শ্রমিক। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শাসকদের দ্বারা তারা ছিল নিপীড়িত এবং বঞ্চিত। এমনিতেই মজুরি ছিল খুবই কম, তার ওপর এই সামান্য উপার্জনে কর আরোপের নির্মম প্রক্রিয়া চালু ছিল। রাস্তাঘাটে তারা প্রতিনিয়ত অপমানিত হতো। বিচিত্র কলাকানুনে তাদের করা হতো নাজেহাল। একটি মামলা লড়তে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী গিয়েছিলেন প্রেটোরিয়ায়। সেখানে ভারতীয় শ্রমিকদের দুঃখ দুর্দশা চাক্ষুষ করে তাদের পাশে দাঁড়ান। নামমাত্র ফি নিয়ে কিংবা অবস্থাদৃষ্টে কোনো ফি না নিয়ে তিনি আফ্রিকার প্রবাসী শ্রমিকদের পক্ষে আইনি লড়াই করেন। ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। ১৯২০ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুর পরে কংগ্রেস নেতৃত্ব শূন্য হবার আশঙ্কায় হাল ধরেন গান্ধী। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন অসহযোগ আন্দোলন। তাঁর সত্যগ্রহ আন্দোলন সব অন্যায় অবিচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ। তারই ধারাবাহিকতায় ভারত ছাড় আন্দোলন করেন ১৯৪২ সালে।

অর্ধশিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে গান্ধী কর্মমুখী ও জীবন কেন্দ্রিক বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তখন ড. জাকির হোসেন ও ড. সর্বপল্লী রাধা কৃষ্ণান সে শিক্ষা ধারণার সাথে উন্নয়ন ঘটান। গান্ধী প্রসঙ্গে এই কথাটা আসার কারণ হলো গান্ধী যে সময়ে ভারতের রাজনীতিতে তৎপর ছিল তখন ব্রিটিশ বাহিত ভারতে সংস্কৃতি, জীবনযাপন, ব্যবসাকেন্দ্র সব ব্রিটিশ অনুগত বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গান্ধী হতে পারেতেন ব্রিটিশ অনুশাসক, সুঃখী আহলাদি মানুষ কিংবা ব্রিটিশের অনুগত নেতা। এটি হতে চাইলে ব্রিটিশরা আরও সুযোগ নিতেন এবং গান্ধীও পেতেন অনেক সুযোগসুবিধা। অথচ তিনি আপোষকামীতায় না জড়িয়ে রক্তপাতহীন ব্রিটিশ উপনিবেশ তাড়ানোর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর দর্শনচিন্তা এবং ভাবকল্পগুলো ভারতবর্ষের জীবনের অন্যতম রূপকল্প ছিল বলে নেতৃত্বের গুণাবলীতে বশ করতে পেরেছিলেন গোটা ভারতবর্ষকে। আমাকে স্পর্শ করে স্বল্প বসন পরিধেয় শুভ্র ও পবিত্র গান্ধী। যেটি সারাবিশ্বের বিস্ময় ও অলংকারে পরিণত হয়েছে। এটিও এক ধরনের বিদ্রোহ বলে মনে হয়। মহাত্মা গান্ধীর এই কৃচ্ছসাধন ভারতবাসীর জন্য পরিমিতিবোধ ও মিতব্যয়ীতার শিক্ষা। আজকের বিশ্ব মিতব্যয়ী চর্চার অভাবে, মানবিকবোধ হীনতার অভাবে বড় রকমের অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। গত দশকে দেখেছি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে আবর্তিত পর্তুগাল ও গ্রিস। ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক সহায়তা ব্যতীত এই দুটো দেশ উঠতেই পারতো না। নতুন করে সেই একইরকম সংকটে ভুগছে এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। জনরোষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হলো মাহিন্দা রাজাপাকশে সহ তার এমপিদের। বিদ্রোহীগণ সরকারপন্থি এক এম পির বস্ত্রহরণ করে নাস্তানাবুদ করেছে সড়কের মাঝখানে। শ্রীলঙ্কার আজকের দুরবস্থার কারণ অতিরিক্ত ব্যয় এবং দুর্নীতি। ঋণে পুরোদস্তুর জর্জরিত এই দেশ। ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতি। এই পেনিন্সুয়ালায় দরকার গান্ধীর পরিমিতিবোধ ও মিতব্যয়িতার চর্চা। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশ সমূহে দেশপ্রেমের চর্চাসহ মানবিক চর্চা বাড়াতে হবে। না হলে সংকট অনিবার্য। আজকের বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দাসহ নেতিবাচক রাজনীতি যুদ্ধনীতি আগ্রাসন যেভাবে ধেয়ে চলেছে, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে ভূখণ্ড আছে মানুষ নেই, ব্যবস্থাপনা নেই। বাংলাদেশও বাইরের কোনো অংশ নয়। বরং বিশ্বের অন্যান্য শরীক দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।

চেষ্টা চলছে নির্ভরশীল একটা অর্থনীতি যেন আমাদের চালিকাশক্তি হয়। আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, এবং কোথায় এ জাতির পরাধীনতা ছিল, সেই ভাষা সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিষয়টি আমাদের সামনে আসতে সময় লেগেছিল ৪৭ এর বিভক্ত রাজনীতির আরও ২৪ বছর পর। তখন রাজনীতিটা বুঝতে সুবিধা ছিল যে, এক দেশ ও জাতি নির্দিষ্ট ভুগোল, অপর দেশ ও জাতি সমূহের মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধান। ভারতবর্ষ ভাগের মধ্যে সব চেয়ে ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল ধর্ম এবং এই ব্যবধান দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রেখেছিল ব্রিটিশ শাসন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মকে অবলম্বন করে পক্ষপাতমূলক একটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে এটিকে প্রস্তাবে এনেছিল। অপরদিকে মহাত্মা গান্ধী। জিন্নাহর চিন্তা ছিল একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের রাষ্ট্র। মুসলমান রাষ্ট্র পেলেও দুই রকমের মুসলমান। গোটা পাকিস্তান নিয়ে এক মুসলমান অন্যদিকে অনগ্রসর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান। তাদের পোক্ত ধারণা ছিল পূর্ববঙ্গে শোষণমূলক অসম সমাজরাষ্ট্রব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। সেই ৪৭ এর বিভক্তিতে পাকিস্তানের কুশাসন বাঙালিকে তৈরি করার প্রস্তুতি দিয়েছিল যেটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭১ এসে শেষ হয়। আমাদের দেশে স্বাধীনতা উত্তর ঢুকে পড়েছে ক্লেদ, দুর্বৃত্তায়ন, স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত, লোভলালসা। এটি আরও পাকাপোক্ত হয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের সাথে রাজনীতির আঁতাত প্রতিষ্ঠা হয়ে। অন্ধ রাজনীতির গুহা থেকে বেরুতে থাকে রাজনৈতিক সাপের সদর্প অংশগ্রহণ, মাঠেময়দানে। সংকট শুরু হয় জাতীয় রাজনীতি থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে। ইউনিয়ন পর্যায়ে যে রাজনীতি অন্তত প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ যদি তৃণমূল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতেন এবং নির্বাচনে জনমানুষের সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনে এগিয়ে আসতে পারতেন, তাহলে এ রাজনীতির একটা ছন্দ তৈরি হতো, ব্যপ্তি ও দর্শনের বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরি হতো। গান্ধীর রাজনীতির যে স্বদেশবোধ, প্রজ্ঞা, দর্শন ও ছন্দময়তা ফিরে পেতে উপরোক্ত রাজনৈতিক চর্চার বিকল্প নেই।

আমাদের দেশের তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি এক শ্রেণির পোশাকি মানুষের দখলে চলে গেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের যে রাজনীতি কিংবা তথাকথিত লোক দেখানো সমাজ সেবার নামে ভণ্ড মানুষের দৌরাত্ম্য যেখানে সর্বদা উপস্থিত সেখানে জনকল্যাণমূলক শুদ্ধ রাজনীতি আশা করা যায় না। রাজনীতির এই দাবানলে বসে মনে পড়ছে স্যার উইন্সটন চার্চিলের মন্তব্য, এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, একজন সার্থক রাজনীতিবিদ হতে হলে তার কোন গুণটি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। চার্চিলের উদ্বেগহীন উত্তর ছিল আগামীকাল কী ঘটবে, আগামী সপ্তাহে কী ঘটবে, আগামী মাসে কোন ঘটনা ঘটবে এবং কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করার অবাধ ক্ষমতা। তারপর যখন দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের শেষে সে গুলোর কোনো কিছুই ঘটলো না, তখন কী কারণে ঘটেনি, সে ব্যাখ্যা দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। সার্থক রাজনীতিবিদ হতে হলে এ গুণটি থাকা প্রয়োজন। তবে, রাজনীতির প্রথম শর্ত হওয়া উচিত মানুষকে ভালোবাসা, উপকার করা। জাতির যেকোনো সংকটে ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্ত জনগণ নিয়ে সংকট মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য ও সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের শক্তি হবে রাজনীতি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা বারংবার ভুলে যাচ্ছি সে বিষয়।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধসুবিধাবঞ্চিত ৫ পরিবারের মাঝে প্রয়াসের ভ্যান গাড়ি বিতরণ