কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল

| বৃহস্পতিবার , ২৩ মার্চ, ২০২৩ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সাকিব আর ওদের শচীন

বাংলাদেশের ক্রিকেটের নির্ভরশীল খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান আবার বিতর্কিত হয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। অন্যসময় সেসব খেলাবিষয়ক হলেও এবারের বিষয়টি তা নয়। এবার তিনি দুবাইতে একটি স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। তাকে কেন্দ্র করেই বিতর্কের সূত্রপাত। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা।

শোবিজ থেকে শুরু করে সমাজের নানাক্ষেত্রের তারকাদের জন্য এমন ঘটনা নতুন নয়। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর আছে। দোকান, শোরুম, শপিংমল, হোটেল, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি উদ্বোধন করতে এ ধরনের তারকাদের ডাক পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে খ্যাতিমান ব্যক্তি বা তারকারা সেখানে উপস্থিত হন। এটা সর্বজনবিদিত যে মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সুপার স্টার শাহরুখ খান, যিনি নিজেই হাজার কোটি রুপির মালিক তিনিও টাকার বিনিময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে পর্যন্ত নাচগান করে থাকেন। কাজেই সাকিব যদি কোনো দোকান উদ্বোধনের জন্য দুবাই গিয়ে থাকেন তা কোনোভাবেই নিন্দনীয় হতে পারে না। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা তেমন ছিল না। কারণ, যার দোকান উদ্বোধনের জন্য তিনি দুবাই গিয়েছিলেন তিনি এক পুলিশ হত্যা মামলার পলাতক আসামি বলে দাবি করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। শুধু তাই নয়, পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে সাকিবকে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও তাতে কর্ণপাত করেননি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আর একে কেন্দ্র করে দেশের গণমাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছেন আরাভ খান নামের সেই স্বর্ণের দোকানের মালিক, বাংলাদেশের পুলিশের খাতায় যিনি পুলিশ অফিসার হত্যার আসামি হিসেবে চিহ্নিত।

আরাভ খান বা যে কোনো খান বা অখানের দোকান উদ্বোধন করা মোটেও দোষের নয়। আর কারো দোকান তাও আবার বিদেশে উদ্বোধন করার আগে তার ঠিকুজি করা তো একজন সেলিব্রিটির পক্ষে সম্বব নয়। ফলে আরাভ খানের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়াও সাকিবের অপরাধ নয়। কিন্তু এখানে সমস্যাটি হলো, পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে তারা আরাভ খান যে খুনের মামলার আসামি তা তাঁরা সাকিবকে জানিয়েছিলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জ্ঞাত করার পরও সে অনুষ্ঠানে যাওয়া দুঃখজনক।

তবে আরাভ খান এক ফেসবুক লাইভে দাবি করেছেন, তাঁর বনানীর অফিসে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন এমরান খান খুন হলেও তিনি নিজে এই খুনে জড়িত নন।

সাকিবের কথায় পরে আসছি। এখানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বলতে চাই, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে বলছে, ‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আরাভ খানের আসল নাম রবিউল ইসলাম। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তাঁর বাড়ি। তিনি সোহাগ মোল্লা, হৃদয় শেখ, আপনএ রকম কয়েকটি নামে পরিচিত। ২০১৮ সালে ৭ জুলাই ঢাকায় পুলিশের একজন পরিদর্শক মামুন এমরান খান খুন হন। সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। ডিবি বলছে, দেশ থেকে পালিয়ে রবিউল ইসলাম প্রথমে ভারত যান। সেখানে আরাভ খান নামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দুবাই চলে যান। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লেখাটি যখন লিখছি সে সময়ের সংবাদ হচ্ছে, এবার দুবাইয়ের বিতর্কিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম আরাভের খোঁজে নেমেছে দুবাই পুলিশ। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরাতে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ। পুলিশ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো রেড নোটিশ গ্রহণ করেছে ইন্টারপোল।

সদস্য দেশগুলো ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতক আসামি সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে এবং সে দেশের সরকার তা খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সে দেশের সরকারই তার বিচার শুরু করবে। আর তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হলে আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তির প্রয়োজন হবে। একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও দুবাইয়ের মধ্যে এই চুক্তি নেই।

এরপরও ধারণা করা হচ্ছে, গ্রেফতার এড়াতে তিনি দুবাই ছাড়তে পারেন। আরাভ খান নাম ব্যবহার করে নেওয়া তার ভারতীয় পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ভিসা রয়েছে।

আরাভ খানের তথা রবিউল ইসলামের একবার গ্রেফতার হওয়া এবং তাকে ছেড়ে দেওয়ার বিতর্কে এক উধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। এ নিয়ে গত সোমবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আরাভ খানের সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন সাবেক কোনো কর্মকর্তার সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে আমরা তা আপনাদের জানাব।

পুলিশ যদি জানতোই পুলিশ খুনের আসামি আরাভ খান নাম ধারণ করে দুবাইতে ব্যবসা করে তাহলে তাকে গ্রেফতারে কোনো পদক্ষেপ এতদিন নেয়নি কেন? এখন যে তৎপরতা দেখাচ্ছে পুলিশ তা আগে দেখাতে বাধা কী ছিল?

এবার সাকিবের প্রসঙ্গে বলি, পুলিশের অনুরোধ বা পরামর্শ যাই বলি না কেন তা অবহিত হওয়ার পরও সাকিব সে অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন কোন ধৃষ্টতায়? তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, বাংলাদেশের ক্রিকেটদলের মূল ভরসা, তাকে ছাড়া দলের জেতা অনিশ্চিত এসব ভেবেই কি? তিনি কি ধরেই নিয়েছেন তাঁকে কিছু করা বা তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেতে পারবে না? সন্দেহ নেই তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটদলের অন্যতম ভরসা। কিন্তু আইন কি সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে না? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির ব্যাপার পুলিশ কঠোর অবস্থান নিতে পারলে সাকিবের বেলায় কেন পারবে না?

সাকিবের ঔদ্ধত্য নতুন নয়। তিনি অনেকবার বিতর্কিত কাজ করে নিন্দিত হয়েছেন। সাজাপ্রাপ্তও হয়েছেন। সেসব ঘটনার ওপর সামান্য চোখ বোলানো যাক

দর্শকের সঙ্গে বাজে আচরণ:

২০১০ সালে প্রথমবার বিতর্কিত কাণ্ড করেন সাকিব। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ব্যাটিং ক্রিজ ছেড়ে বাউন্ডারি লাইনে ছুটে গিয়ে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যাট উঁচিয়ে দর্শককে হুমকি দেন।

বিশ্বকাপে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বাজে ইঙ্গিত:

২০১১ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৫৮ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। সাকিবকে ইঙ্গিত করে গ্যালারি থেকে দুয়োধ্বনি আসতে থাকে। তখন দর্শকদের উদ্দেশ্যে মধ্যমা আঙুল দেখিয়ে বাজে ইঙ্গিত করেছিলেন সাকিব।

দর্শকের কলার চেপে ধরা:

২০১৩ সালে অটোগ্রাফ চাওয়া এক দর্শকের কলার চেপে ধরে ফের বিতর্কে জড়ান সাকিব।

তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ:

২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ছক্কা মারতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দিয়েছিলেন সাকিব। এই আউট নিয়ে টিভি ধারাভাষ্যকাররা আলোচনা করার সময় ক্যামেরা দেখে অশালীন ভঙ্গিতে বাজে ইঙ্গিত করেন সাকিব। আর তাতেই তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি।

২০১৫ সালের বিপিএলে সিলেট সুপার স্টার্সের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন রংপুর রাইডার্সের সাকিব।

অনাপত্তিপত্র না নিয়ে ক্যারিবীয় যাত্রা:

বিসিবির অনাপত্তিপত্র না নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব। তাকে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়ার পর রাগের মাথায় টেস্ট ও ওয়ানডে দল থেকে অবসর নেওয়ার হুমকি।

শ্রীলঙ্কা সফরে না যাওয়া:

সন্তানসম্ভাবা স্ত্রীর পাশে থাকতে নিউজিল্যান্ড সফরে ছুটি নিয়েছিলেন, পরে আবার আইপিএল খেলতে ছুটি চান সাকিব। শেষ পর্যন্ত লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ বাদ দিয়ে আইপিএল খেলেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।

জৈব সুরক্ষা বলয় ভঙ্গ:

গত ৪ জুন মোহামেডানের অনুশীলন না থাকলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুশীলন করেছিলেন সাকিব। এই অনুশীলনেই জৈব সুরক্ষা ভেঙেছেন তিনি। সুরক্ষা বলয়ে না থাকা একজন নেট বোলারকে নিয়ে অনুশীলন করেছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, সাকিবের অনুশীলনের সময় সেখানে সাদা শার্ট পরা একজনকে দেখা যায়। জানা যায়, নেট বোলার ছিলেন মাস্কো সাকিব ক্রিকেট একাডেমির। আর তার সঙ্গেই সাদা শার্ট পরা ব্যক্তিটি এসেছিলেন। এমন ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে ক্ষমা চান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।..

৪ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির তদন্তে সাকিব আল হাসানের নাম। শেয়ারবাজার কারসাজির বিষয়ে সরকারি তদন্তে নাম আসায় আবার আলোচনায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, কারসাজির সময় সাকিব আল হাসান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেশ কয়েকবার বিপুল সংখ্যক শেয়ার লেনদেন করেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)২০২১ সালের ৫ মে থেকে ২০২২ এর ১০ মার্চ পর্যন্ত ৪টি তদন্ত চালায়। বিএসইসির তদন্তে গত ২ বছরে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম হেরফের করার জন্য মোনার্ক হোল্ডিংসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। মোনার্ক হোল্ডিংস ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রোকারেজ হাউস হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাকিব আল হাসান।

আসলে ভালো খারাপের ধারণাটি তুলনামূলকও বটে। যেমন আমাদের ক্রিকেটার সাকিব যখন বাজে কাজ করেন, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন তখন ক্রিকেটপ্রেমী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তুলনামূলক বিচার করেন। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ভারতের ক্রিকেটঈশ্বর বলে খ্যাত শচীন টেন্ডুলকারের কথা। রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টির পরও তিনি কেমন শালীন, শোভন, মার্জিত আচরণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ধনী এই ব্যক্তি মহামারিকালে কীভাবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এখনো নীরবেনিভৃতে আর্তমানবতার সেবা করে যাচ্ছেন।

এখানেই আমাদের দুঃখ। এখানেই আমাদের হতাশা। কারণ সাকিবকে আমরা ভালোবাসি। তিনি আমাদের দেশের প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠতে পারতেন যেভাবে বিভিন্ন দেশের সেলিব্রিটিরা হয়ে আছেন, হয়ে উঠছেন।

লেখক: কবি, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধউত্তাল মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণ
পরবর্তী নিবন্ধচবিতে ‘সিটিজেনস চার্টার’ প্রস্তুতকরণ শীর্ষক কর্মশালা