ঈদ মানে খুশি আনন্দ। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ছোট–বড়, ধনী–গরিব সবাই মিলে ঈদ আনন্দে অংশীদার হয়। ঈদগাহে সবাই এক কাতারে সামিল হয়। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ/ তোর সোনা–দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ/ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে/ যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ/ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের এই গান ছাড়া ঈদের আনন্দ যেন পরিপূর্ণতা পায় না। যতদূর জানা যায়, নজরুল এই গানটি রচনা করেন ১৯৩১ সালে আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধে। লেখার মাত্র চার দিন পর আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা’য় আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন -‘কাজীদার লেখা গান অনেকগুলো ইতোমধ্যে রেকর্ড করে ফেললাম। তার লেখা ‘রেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর’, ‘অনেক কিছু বলার যদি দুদিন আগে আসতে’, ‘গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই’, ‘বন্ধু আজও মনে পড়ে আম কুড়ানোর খেলা’ ইত্যাদি গানগুলো রেকর্ড করলাম।
একদিন কাজীদাকে বললাম, কাজীদা একটা কথা হয়, এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল –এরা উর্দু কওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি, অসম্ভব বিক্রি হয়। এ ধরনের বাংলায় ইসলামি গান দিলে হয় না? গানটি প্রথম গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন নিজেই। লেখার কদিন পরেই রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর সে কী কাণ্ড। কলকাতার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লো এই সংগীতটি। মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো আর ভাবছিল ইসলামিক গানও এত সুন্দর হতে পারে! এইচএমভি কোম্পানি দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করতে লাগলো। ভগবতী বাবু নজরুলকে আরও ইসলামিক সংগীত লিখতে উৎসাহ দিলেন। এভাবেই শুরু হলো নজরুলের ইসলামিক সংগীতের নতুন যাত্রা। যার শুরুর ফলটা ওই তিনজনের– নজরুল, আব্বাসউদ্দীন এবং ভগবতী। এরপর কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীমউদ্দীনও এগিয়ে এলেন।
‘ঈদ এসেছে দুনিয়াতে শিরণী বেহেশতী/ দুষমনে আজ গলায় গলায় পাতালো ভাই দোস্তী/ জাকাত দেবো ভোগ–বিলাস, আজ গোস্বা/ বদমস্তি/ প্রাণের তশতরীতে ভরে বিলাব তৌহিদ/ চলো ঈদগাহে।’ ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি যেন সকল ভেদাভেদ দূর করে দেয়। বাসায় চলে সেমাই, জর্দ্দা, পোলাও– কোরমা, বিরিয়ানিসহ আরও কত পদের রান্না হয়ে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। শিশুদের ঈদ সেলামি সংগ্রহ আনন্দের আরেক অনুষঙ্গ। ঈদ উপলক্ষে অন্তত এক–দুইদিন সামাজিকভাবে একে ওপরের সঙ্গে মেলামেশা, খোঁজ–খবর নেয়া, জমিয়ে আড্ডা দেয়া চলে। গ্রামে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গ্রামীণ সামাজিক বন্ধন নির্মাণমূলক সমাবেশ ও অনুষ্ঠানও অনেক জায়গায় হয়ে থাকে। হিজরির ২য় সাল থেকেই রমজান মাসের শেষে ঈদ–উল–ফিতর উৎসব উদযাপনের সূচনা হয়।
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবে গ্রামবাংলায় এমন কী শহরেও মেলা বসে। মেলায় লোকশিল্পজাত নানা পণ্যদ্রব্য বিক্রি হয়। বিক্রি হয় খাবার জিনিসপত্র। কোনো কোনো মেলায় নাগরদোলা, ছবির খেলা, পুতুল নাচ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়। নানা ধরনের খেলাধুলা হয়। মুর্শিদি, মারফতি গানের আসর বসে। এসব কিছুই ঈদ উৎসবকে আরো আনন্দময় এবং প্রাণবন্ত করে তোলে।
বাংলাদেশে ঈদ–উৎসব এখন শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বহুমাত্রিক জাতীয় সামাজিক উৎসবও বটে। এর মধ্যে আছে সামাজিক–সাংস্কৃতিক–অর্থনৈতিক–বিনোদনমূলক নান্দনিক নানা বিষয়। বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ছিল ইংল্যান্ড, কলকাতা ও ইসলামাবাদের পশ্চাৎভূমি। ফলে পাটের মৌসুম ছাড়া তাদের হাতে নগদ পয়সা থাকত না। আর কাঁচা পয়সা ছাড়া উৎসব হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি ব্যবসা–বাণিজ্য, চাকরি এবং বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের পাঠানো টাকায় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। তাই ঈদ এখন এত জমজমাট। উৎসব মানেই তো আনন্দদায়ক। লোভ–লালসা, হিংসা–বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত হোক বিশ্ব। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সবাই এগিয়ে আসবে, মঙ্গলময় হোক ঈদ।