হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

একাত্তরের গণহত্যা
বিশ্ব কতটুকু জানে-১
ওরা ১৩ জন। সবাই হল্যান্ডের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণী। লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় ও নাইমেইখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বেশির ভাগ ইউরোপীয়। ডাচ ছাড়াও ওদের মধ্যে আছে ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে হল্যান্ডে পড়তে আসা। একজন ছাড়া এদের কারো সাথে আমার পরিচয় ছিল না, এই প্রথম দেখা ও অনুষ্ঠান শেষে কয়েক জনের সাথে স্বল্প আলাপচারিতা। এদের মধ্যে যে মেয়েটিকে চিনি সে আমার অফিসেই কাজ করে। নাম মাই লি জেনিন ব্রেনডেল। হ্যাংলা-পাতলা গড়নের দীর্ঘাঙ্গী এই মেয়েটি পুরোপুরি ইউরোপীয় নয়, মিঙড। মা ভিয়েতনামী, বাবা জার্মান। জন্ম জার্মানীতে, থাকে সে দেশে। লেখাপড়ার সূত্রে তার হল্যান্ড আসা এবং থাকা। বাংলাদেশকে জানার প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে এদের সবার আসা, ‘করোনার’ এই দুঃসময়েও। তারা এসেছিল হেগ শহরে ডাচ পার্লামেন্ট ভবনের প্রেস সেন্টারে। ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। তাদের সংখ্যা আরো বাড়তো। কিন্তু কোরোনার ফলে সরকারের বেঁধে দেয়া বিধি নিষেধের কারণে অন্যদের ‘না’ করতে হয়েছে। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত (মাঝখানে এক ঘন্টার লাঞ্চ বিরতি) যে আলোচনা চলেছিল, লক্ষ্য করি তাদের প্রত্যেকে গভীর মন দিয়ে শুনছে। কেউ কেউ নোট খাতায় পয়েন্ট টুকে নিচ্ছে। তাদের একজন জানালে, ‘সে এই প্রথম জেনেছে যে বাংলাদেশে কখনো গণহত্যা হয়েছিল।’ তাদের গভীর আগ্রহে উৎসাহিত হই। ভালো লাগে। অন্যদিকে উপস্থিত বাংলাদেশিদের কয়েকজনকে দেখেছি লাঞ্চের পর কেঁটে পড়তে। সম্মেলনের বিষয় সিরিয়াস তাতে কোন সন্দেহ নেই। বক্তাদের কেউ কেউ একাত্তরে তাদের ব্যক্তিগত কষ্ট, হারানোর কথা, বেদনার কথা দর্শক-শ্রোতাদের সাথে ভাগাভাগি করেন। হংকং থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেয়া পাকিস্তানি নির্বাসিত নাগরিক বশির নাভিদ তার নিজ সিন্ধ গোষ্ঠীর উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালায়, নারীদের যে হারে ধর্ষণ করে তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। সেই গণহত্যার কোন বিচার হয়নি। আর বিচার হয়নি বলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৫০ বছর পরও আজ পাকিস্তান তার নিজ দেশের সিন্ধ, বেলুচ, পশতুন ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। একাত্তর গণহত্যার যদি বিচার হতো তাহলে আজ এমনটি হতো না।’ বশির নাভিদের কষ্ট, বেদনা বুঝি। দেশে তার নিজ জনগণের উপর পাক সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই-এর অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তাকে না পেয়ে তার ছেলেকে পাক সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে অত্যাচার করে হত্যা করে বলে জানান এই ষাটোর্ধ্ব নির্বাসিত পাকিস্তানি মানবাধিকার নেতা। বর্তমানে তিনি হংকং-এ ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের কার্যকরী পরিচালক হিসাবে কাজ করছেন।
তেমনি স্বজন হারানোর কথা ভাগাভাগি করলেন ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগ দেয়া প্রফেসর ড. নুজহাত চৌধুরী। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য। তার বাবা বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী ড. আলিম চৌধুরী। দেশ স্বাধীন হবার ঠিক একদিন আগে আলবদর-রাজাকাররা আরো অন্যান্য বুদ্ধিজীবির সাথে তার বাবাকেও তার বাসভবন থেকে তুলে নেয় এবং এরপর তার আর কোন সন্ধান মেলেনি। আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে ড. নুজহাত চৌধুরী ইউরোপীয় জনগণকে, বিশ্বকে অনুরোধ জানান একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেবার জন্যে। তিনি বলেন, ‘বিচারহীনতাকে যদি চলতে দেয়া হয়, তাহলে গণহত্যা চলবেই। যা আমরা দেখছি পাকিস্তান, আফগানিস্থান সহ বিশ্বের অনেক দেশে।’ অনুরূপ বক্তব্য রাখেন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা পাকিস্তানের পশতুন নাগরিক ‘পশতুন টাইমসের’ তরুণ সম্পাদক আওরঙ্গজেব খান জালমে, হল্যান্ডের আফগান-ডাচ ডায়াসপোরা মুভমেন্টের কো-ফাউন্ডার তরুণী খাতেরা সাঘাসি। সবাই বাংলাদেশের দাবির প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশে সংঘটিত ও চলমান গণহত্যা এবং বাংলাদেশের একাত্তর সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানান। কোরোনার কারণে এটি ছিল ‘হাইব্রিড’ সম্মেলন। তিন বক্তা তাদের বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করে সম্মেলনের আগেভাগেই পাঠিয়ে দেন। এই তিন জন হলেন কানাডা থেকে ক্রিস্টোফার আলেক্সান্ডার, লন্ডন থেকে বাংলাদেশি গবেষক ড. রায়হান রশিদ ও ঢাকা থেকে প্রফেসর ড. নুজহাত চৌধুরী। ক্রিস্টোফার আলেক্সান্ডার কানাডার প্রাক্তন মন্ত্রী ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত কানাডার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত।
সম্মেলনের শুরু ‘ওয়ার ক্রাইমস ১৯৭১’ প্রামাণ্য চিত্র দিয়ে। তাতে একাত্তর সালে হানাদার পাক বাহিনীর গণহত্যার বিভিন্ন চিত্র ও দিক তুলে ধরা হয়। তুলে ধরা হয় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষিত বাঙালি রমনীদের করুন ও ব্যাথাভরা কাহিনী। ছবিটি যখন সম্মেলন কক্ষের তিন দিকের বড় আকারের পর্দায় দেখানো হচ্ছিল, তখন পিন পতন নীরবতা। ছবির পর আলোচনা। তাতে শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, হল্যান্ড ও বেলজিয়াম থেকে আসা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা। বক্তব্য রেখেছিলেন হল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদউল্লাহ, লন্ডন থেকে আসা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেয়া ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পুরস্কার-প্রাপ্ত বৃটিশ সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা পাকিস্তানের পশতুন নাগরিক ‘পশতুন টাইমসের’ সম্পাদক আওরঙ্গজেব খান জালমে, হল্যান্ডের আফগান-ডাচ ডায়াসপোরা মুভমেন্টের কো-ফাউন্ডার খাতেরা সাঘাসি, ফিনল্যান্ড থেকে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. মজিবুর দফতরি ও বেলজিয়াম থেকে বুদ্ধিজীবী ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ।
গণহত্যা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদ উল্লাহ দর্শক-শ্রোতাদের লক্ষ্য করে জানতে চাইলেন, তাদের মধ্যে কেউ ‘দি প্রমিজ’ ছবিটি দেখেছেন কিনা। আর্মেনীয় গণহত্যার পটভূমিতে নির্মিত অস্কার পুরস্কার প্রাপ্ত এই ছবিটি নির্মাণ করেন আইরিশ পরিচালক টেরি জর্জ, ২০১৮ সালে। ত্রিভুজ প্রেমের গল্প নিয়ে গড়ে উঠে এর কাহিনী এমন এক সময় যখন তুরস্কের অটোমান শাসনামলে ১২ থেকে ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় নাগরিককে হত্যা করা হয়। সেটি ঘটেছিল ১৯১৪-১৯২৩ সালের মধ্যে। তবে কারো কারো মতে এই সংখ্যা ছিল ২২ লাখের মত। সুদীর্ঘ ১০০ বছর পর অনেক দাবি, বিশ্বব্যাপী প্রচারণা, তীব্র প্রতিবাদের পর চলতি বছর (২০২১) আর্মেনীয় গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। তুরস্কের তীব্র প্রতিবাদের মুখে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, রাশিয়া, ব্রাজিলসহ ৩০ দেশের সরকার ও পার্লামেন্ট সরকারিভাবে আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়। তবে এর পেছনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত আর্মেনীয় ডায়াসপোরার অবদান উল্লেখ করার মত। ‘দি প্রমিজ’ ছবিটি বাণিজ্যিক সফল না হলেও আন্তর্জাতিকভাবে আর্মেনীয় গণহত্যাকে বিশ্ব জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। সেই কথাটিই বলেছিলেন ছবির পরিচালক টেরি জর্জ। তিনি বলেছিলেন, ‘দর্শকরা বই পড়ে যতটুকু না এই গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারবেন, তার চাইতে বেশি জানতে পারবেন এই ছবি দেখে।’ কথাটি কতটুকু সত্য সে টের পেয়েছিলাম যখন অনেকটা স্বাসরুদ্ধকর ছবিটি দেখেছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীনতা যুদ্ধ-নির্ভর, পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা-নির্ভর বাংলাদেশে যে ছায়াছবি নির্মিত হয়নি তা নয়। বেশ কিছু ছায়াছবি ছবি, ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রভাব রাখতে পারে তেমন কিছু তৈরি হয়নি বলে ধারণা। এবং এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বোধকরি রাষ্ট্রদূত এম হামিদ উল্লাহ উদ্ভাবনী-শক্তি কাজে লাগিয়ে ‘বার্তা’ পৌঁছে দেবার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ গণহত্যা উপর গুগল সার্চ করলে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ প্রসঙ্গে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে তিনি বড় সাইজের এক পোস্টারের কথা উল্লেখ করেন যেখানে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের শিকার এক রোহিঙ্গা পরিবারকে দেখানো হয়। তাতে দেখা যায় টেকনাফ উপজেলায় মিয়ানমার থেকে জীবনের ভয়ে পালিয়ে আসা একটি রোহিঙ্গা পরিবার। বাবার কোলে একটি শিশু। পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীর চোখে মুখে একরাশ হতাশা। দুজনেই তাকিয়ে আছে যেন অনাগত অনিশ্চিত আগামীর দিকে। মাঝে দাঁড়িয়ে তাদের সন্তান। পোস্টারের গায়ে বড় অক্ষরে লেখা- ‘ডযবহ ইঁফফযধ খড়ড়শং অধিু’ পোস্টারের এক কোনায় মহামতি গৌতম বুদ্ধের বাণী- ‘ওহ ংবঢ়ধৎধঃবহবংং ষরবং ঃযব ড়িৎষফ’ং মৎবধঃ ংঁভভবৎরহম, ওহ ঁহরঃু, ষরবং ঃযব ড়িৎষফ’ং মৎবধঃ ংঃৎবহমঃয’ অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতায় নিহিত রয়েছে পৃথিবীর বড় দুঃখ, ঐক্যে রয়েছে বড় শক্তি। মাত্র ক’টি শব্দ অথচ কী আবেদন। পুরো বিষয়টি কীভাবে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাদেরও এই ধরনের নতুন কিছু ভাবতে হবে, উদ্ভাবন করতে হবে যাতে আমাদের বার্তা অর্থবহ হয় এবং সঠিকভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেয়া যায়।’ পোস্টারটি তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের সেরা ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম। আগামী সংখ্যায় ফিরে আসবো ওই ১৩ জন তরুণী প্রসঙ্গে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্রণ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধউন্নয়ন-অগ্রগতির বিশ্বস্বীকৃতি