হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

চা-শিল্প : শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে দেশের অর্থনীতিও এগিয়ে যাবে

চা খেতে খেতে এই লেখা লিখছি। দিনে নিদেনপক্ষে বার ছয়েক চা খাওয়া হয়। কাপে নয়, মগে। একসময় দুধ আর চিনি দিয়ে খাওয়া হতো, এখন বয়স বাড়ছে, বলা যায় বেড়েছে। এখন দুধ-চিনিকে সাধে নয় বাধ্য হয়ে বর্জন করতে হয়েছে, এখন কেবল চা খাওয়া হয়, রং চা। ইংরেজিতে যাকে বলি ‘র টি’। একবার এক চায়ের আসরে দুধ-চিনি মিশিয়ে চা খেতে দেখে আমার এক ইংরেজ-বন্ধু বলে উঠে, ‘তুমি তো চা খাচ্ছনা, চা-কে ‘স্পয়েল’ (নষ্ট) করছো।’ কথাটা সত্যি তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই মেনে নিলাম তার মন্তব্য। সে আড্ডায় আমাদের সার্ভ করা হয়েছিল ‘ইংলিশ টি’। মুখে অর্থবহ হাসি মেলে ধরে তাকে বলি, ‘এই যে তোমরা বলো ‘ইংলিশ টি’ সেটি কিন্তু ঠিক নয়। আমার জানা মতে কোন ইংরেজ-ভূখণ্ডে এখন চা উৎপাদন হয় না। এক সময় হতো, যখন ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত যায় না’ বলে একটা প্রবাদ ছিল। এখন তো তোমাদের আর সে সাম্রাজ্য নেই। এই যে তোমরা এখনো বলো, ‘গ্রেট বৃটেন’ এটিও ঠিক নয়। বৃটেনের আগের সে জৌলুস অনেক আগেই গেছে, ‘গ্রেট’ হারিয়ে বৃটেন এখন অনেকটা বিগত যৌবনা-রমণীর মত, কেবল বৃটেন। তোমাদের সেই সোনালী দিনগুলির সময় যে-সমস্ত দেশে তোমরা চা উৎপাদন করতে, তার সবকটি এখন তোমাদের হাতছাড়া। তারপরও ‘ইংলিশ টি’ বলা কি সঠিক? আমার ইংরেজ বন্ধুর মুখে ‘রা’ নেই। সে চায়ে চুমুক দেয়।
আমার মত অনেকের দিন শুরু হয় এক কাপ চা খেয়ে এবং দিনও শেষ হয় এক কাপ চায়ের মধ্যে দিয়ে। হল্যান্ডে ‘নাইট টি’ নামে এক ধরনের টি-ব্যাগ পাওয়া যায়। সেটি প্রতিরাতে খাওয়া হয়। তাতে ঘুমের কোন ব্যাঘাত হয়না। সেই যে কবে চীনের ইয়েনান এলাকায় প্রথম চায়ের চাষ শুরু এবং বলা হয়ে থাকে বৌদ্ধ পন্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান হলেন প্রথম বাঙালি যিনি চা খাওয়া শুরু করেন। বাংলাদেশে বর্তমানে যে তথ্য আমার কাছে আছে সে অনুযায়ী ১৭২টি চা-বাগান রয়েছে। দৈনিক আজাদীতে ৩০ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ২৫৬টি উল্লেখ করা হয়। চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, ঠাকুরগাঁও- দেশের এই সমস্ত চা-বাগানে উৎপাদিত হয়ে থাকে বিশ্বমানের চা। বিশ্বে উৎপাদিত চায়ের মোট ৩% ভাগ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। চা-উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশে এই চা-উৎপাদন শুরু বৃটিশ শাসনামলে। এই যে বিশাল পরিমাণ চা বাংলাদেশ উৎপাদন ও রপ্তানি করে দেশের জন্যে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করছে, তার পেছনে রয়েছে চার লক্ষেরও বেশি চা-শ্রমিকের অবদান, যারা রোদে পুড়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ‘একটি কুঁড়ির দুটি পাতা’ তুলে পিঠের উপর থাকা কাপড়ের ব্যাগে ভরে। দিনে আট-দশ ঘন্টা কঠিন পরিশ্রম শেষে তারা পেতেন মাত্র ১২০ টাকা। কেউ কেউ বলেন আরো বেশি ঘন্টা তাদের কাজ করতে হয়। তর্কের খাতিরে যদি দিনে ৮ ঘন্টাই ধরি, তাহলে প্রতি ঘন্টায় তারা পান মাত্র ১৫ টাকা। মালিক পক্ষ দাবি করেন তারা নামমাত্র-মূল্যে চাল, গম পেয়ে থাকেন। শ্রমিকদের বক্তব্য মালিক পক্ষের এই দাবিতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এখন একজন বিবেকবান মানুষ বলুক ঘন্টায় ১৫ টাকা কি তাদের এই কঠিন পরিশ্রমের তুলনায় পর্যাপ্ত? একটি ডিমের দাম কত? বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা তপন দত্ত মালিক পক্ষের দেয়া চাল গমের হিসাবকে ‘গালগপ্প’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এখানে যে কত ধরণের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে তার তথ্য উপাত্ত আমাদের কাছে রয়েছে, যথাসময়ে তা উপস্থাপন করবো।’
চা শ্রমিকদের যাপিত জীবনের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এটি কারো কাছে অজানা নয় যে তাদেরকে নিকট অতীতেও ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করা হতো। এখন হয়তো সে-মাত্রায় হয়না। টি-গার্ডেনের ম্যানেজার বাগান ঘুরে বাংলোয় এসে পা বাড়িয়ে ছড়িয়ে বসেন এবং চা-বাগানের কোন শ্রমিক তার জুতো-মৌজা খুলে দিচ্ছেন- এ গল্প নয়। এমনটি অতীতে ঘটতো, এখন ঘটে কিনা জানা নেই। খুব বেশি দিনের কথা নয়। আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী ও বন্ধু বশির অনেক বছর সিলেটের একটি প্রথম শ্রেণির চা-বাগানে ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতো। তখন আমি ঢাকায় সাংবাদিকতা করি। হঠাৎ এক দুপুরে আমার অফিসে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চল বাইরে যাই’। হাতে তার চাবি। জিজ্ঞেস করি, ‘কি মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছিস?’ বলে, ‘আরে না, গাড়ি।’ তার গাড়ি চড়ে প্রথমে গেলাম গুলিস্তান, তারপর এক রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা। সে আড্ডায় সে বলে চলে তার ‘জমিদারি’ স্টাইলে চলা টি-গার্ডেন ম্যানেজারের জীবন-কাহিনী। পাশাপাশি তার মুখেই শুনি চা-শ্রমিকদের, যাদের অধিকাংশ নানা বয়েসী মহিলা, দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী। শুনে মনটা খারাপ হয়ে পড়েছিল। তবে বশিরের মাঝে কোন অনুশোচনা কাজ করছে বলে মনে হলোনা। এটি ৯০ দশকের কথা। এর ১৫-১৬ বছর পর এই সমস্ত খেঁটে-খাওয়া, স্বাস্থ্যহীন শ্রমিকদের অতি কাছ থেকে দেখার, তাদের সাথে তাদের বাড়ির উঠোনে বসে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী শোনার সুযোগ হয়েছে, যখন আমরা একদল উন্নয়ন কর্মী হবিগঞ্জের কয়েকটি চা-বাগানে যাই। আমার সাথে গিয়েছিলেন আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক ড. খেরট ইউনে, তার অধীনে থাকা এক তরুণী সিনিয়র রিসার্চার ড্যানিয়েলা দি বীনটার। ছিলেন বেলজিয়াম থেকে ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন ও লন্ডন থেকে আনসার আহমদ উল্লাহ। আমাদের গাইড ছিলেন স্থানীয় এক এনজিওর কার্যকরী পরিচালক খলিলুর রহমান চৌধুরী। অক্সফাম নভিবের সহযোগিতায় ওই কটি বাগানে সে সময় চা-শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষে একটি প্রকল্প চলছিল। আমাদের সাথে আসা জার্মান-ডাচ এই প্রফেসর ও ড্যানিয়েলার মন খারাপ হয়ে গেলো শ্রমিকদের সে-সময়কার পরিস্থিতির কথা শুনে। তারা বলছিলেন তাদের সুখ-দুঃখের কাহিনী। কথাটি বোধকরি ঠিক বলা হলোনা। বলা উচিত ছিল কেবল দুঃখের কাহিনী। তাদের যে সুখের কোন কাহিনী নেই। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ যাদের তাদের আবার কী সুখের-কাহিনী থাকতে পারে। চা-বাগানের মালিকেরা এদের চাওয়া-পাওয়া বরাবর অগ্রাহ্য করে এসেছে। বৃটিশ আমলে তাদের যেভাবে ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করা হতো, তেমনটি হয়তো এখন হয়না। তবে তাদের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন এখনো হয়নি বলে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে জানতে পারি। এখন তারাও নিজেদের অধিকার নিয়ে অনেক সচেতন। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে তাদের শোষণ করা হবে এতো কারো কাম্য নয়। তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে যে বাংলাদেশের চা-শিল্পের উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
কেউ কেউ দোষারূপ করছেন শ্রমিকরা আন্দোলন করে, কাজ বন্ধ করে দিয়ে চা-শিল্পের অনেক ক্ষতি করেছেন। ক্ষতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই ক্ষতিটা এড়ানো যেত যদি চা-শ্রমিকরা যে ন্যায্য দাবির জন্যে তারা আন্দোলন করছিলো সেই দাবিগুলি মেটানোর প্রচেষ্টা চালানো হতো। তেমনটি হয়নি। শ্রমিক নেতার মতে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। এছাড়া তাদের আর অন্য কোন রাস্তা খোলা ছিল না। এমনটি না করলে আজ যে তাদের দাবির কিছুটা হলেও মেটানো হয়েছে তা হতোনা। হয়তো হতোনা যদিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এই ব্যাপারে উদ্যোগ না নিতেন। মালিকদের কেউ কেউ অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এর ফলে চা-শিল্পের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল, চা-শিল্প ধ্বংসের মুখে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একটু ব্যতিক্রম-প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, এম এম ইস্পাহানীর চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানী। তিনি বলেন, শ্রমিক-আন্দোলনের ফলে চা-শিল্পের বড় ক্ষতি হয়েছে। তবে তিনি এটিও বলেন, ‘সবমিলে গড়ে শ্রমিকরা ৪২৫ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেতেন। তবে এটি কম। একজন মানুষকে ‘সারভাইব’ করতে হবে তো। এতো কমে একজন মানুষ সারভাইব করতে পারেনা।’ মির্জা সালমান ইস্পাহানী এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি যে দৃষ্টিকোণ থেকে গোটা বিষয়টিকে দেখেছেন বা দেখছেন, তা যদি সকল মালিকরা দেখতেন তাহলে সামপ্রতিক সময়ে চা-শিল্পের জন্যে এমন বৈরী পরিস্থিতির উদ্ভব হতোনা। সবাইকে মনে রাখতে হবে, শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে শ্রমিক, পাশাপাশি দেশও এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। সবার মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক এমনটি প্রত্যাশা করি।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর সাজসজ্জা ও আত্মমর্যাদা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু হত্যা : পৃথিবীর কান্না