হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৬ আগস্ট, ২০২২ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

অনন্য প্রতিভার অধিকারী প্রতিভা
মুৎসুদ্দির সাথে একান্তে -১
‘তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি/গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি’- এমন করে গেয়েছেন কিশোর কুমার, মুকুল দত্তের লেখা এই গান। কিন্তু আমি তাকে ভালবেসেছি- অল্প নয়, অনেক। অনেক আগ থেকেই। তার প্রতি আমার এই ভালোবাসার সাথে মিশে আছে অপার শ্রদ্ধা। কেবল আমি নই, তাকে ভালোবেসেছেন, ভালোবাসেন অনেকে। শ্রদ্ধা করেন সবাই। সেই স্কুল-কলেজ বয়স থেকে তার কথা শুনে আসছি। তার এতো গুণগান! কিন্তু গুণের-আঁধার যে অনন্য ব্যক্তিটি তার সাথে দেখা হলো মাত্র কিছুদিন আগে। কী সাধারণ! দেখে মনে হয় আর দশ নারীর মত একজন। দেখে মনে শ্রদ্ধা জাগে আপনাতে। এখন বয়সের ভারে তার চলাচল, দৈনন্দিন কাজে আগের সেই ব্যস্ততা নেই, কিন্তু কাজ একেবারে থেমে নেই। সাতাশি পেরিয়েও তার স্মৃতিশক্তি এখনো প্রখর, কানে কিছুটা কম শোনেন, মেশিন লাগিয়েছেন, সে কথা নিজেই জানালেন। কথা বলেন স্পষ্ট, মাঝে মধ্যে শাসনের সুরেও। হাজার হলেও শিক্ষক তো। শিক্ষকরা কথা বলেন, বলতে পছন্দ করেন, শাসনও করেন। সে আবারও টের পেলাম যখন কথা হচ্ছিল একান্তে মির্জাপুরে তার বাসভবনে, অন্যন্য প্রতিভার অধিকারীনি, সবার শ্রদ্ধাভাজন এই প্রতিভা মুৎসুদ্দির সাথে। তার আর কোন বিশেষণ বা ইন্ট্রোডাকশন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনে। বাংলাদেশে একজনই প্রতিভা মুৎসুদ্দি রয়েছেন, ২০২০ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। এই নাম উঠে এলেই উঠে আসে ভারতেশ্বরী হোমসের কথা। উঠে আসে দানবীর আর পি সিনহা অর্থাৎ রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সিনহার কথা। যিনি নারী শিক্ষায়, নারীর অগ্রগতি ও কল্যাণে পাকিস্তান আমল থেকে এই অঞ্চলে নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিলেন। যখন প্রেমে পড়ার বয়স সেই স্কুল-কলেজ সময়ে দেখতাম ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের জাতীয় দিবস অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় মার্চপাস্ট, শরীর চর্চা। দেখে মুগ্ধ হতাম। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারতেশ্বরী হোমস ছিল নারী-শিক্ষা ও শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাবলম্বী করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ও বোধকরি একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই ১৯৩৮ সালের ২ জানুয়ারি ‘ভারতেশ্বরী বিদ্যাপাঠের’ যাত্রা শুরু, যা পরবর্তীতে ‘ভারতেশ্বরী হোমস’ নাম ধারণ করে দেশে নারী-শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে আজ অবধি। মেয়েদের জন্যে এটি একটি আবাসিক স্কুল। কুমুদিনী ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহার স্ত্রী, কিরণ বালা সাহা এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার বিশাল ম্যুরাল চোখে পড়লো মূল গেইট পেরিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ঢুকতেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগ তক এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মাধ্যম বাংলা করা হয়। অনেকদিন ধরে ঠিক করে রেখেছিলাম দেশে গেলে, সময়ের যত ঘাটতি থাকুক, ‘ভারতেশ্বরী হোমস’ ঘুরে আসবোই। ‘করোনা’ শুরুর আগে ২০২০ সালে যখন দেশে যাই, এমনকী তার আগের বছরও, কথা ছিল মির্জাপুর যাব, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে আসবো। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে হয়ে উঠেনি। ঘুরে আসার কথা দিয়েছিলাম আভা বড়ুয়াকে, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকাকে। সম্পর্কে তিনি আমার বেয়াইন। এখন অবসরে, স্বামী মৃদুল কান্তি বড়ুয়া একই প্রতিষ্ঠানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে এখনো কর্মরত। সময়ের কারণে একবার ভেবেছিলাম, এবারও বুঝি যাওয়া হলোনা। যেদিন যাবার-বাহন ঠিক হলো, তখনই নিশ্চিত হলাম যে আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ‘পূরণ’ হতে যাচ্ছে। আমাদের গাইড আভা বড়ুয়ার একমাত্র কন্যা, প্রতিষ্ঠা, ভাগ্নে কনকের স্ত্রী। প্রতিষ্ঠা বিসিএস পাস দিয়ে বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা। তার এক ভাই, প্রত্যয়। সে ডাক্তার। নাম শুনে প্রশ্ন জাগে- ভারতেশ্বরী হোমসের সাথে জড়িত যারা তাদের সবার নাম কি ‘প্র’ দিয়ে শুরু? প্রতিভা, প্রতিষ্ঠা, প্রত্যয়। আভা বড়ুয়ার যদি আরো দুটি ছেলে-মেয়ে হতো তাদের নাম হয়তো রাখতেন প্রসেনজিৎ ও প্রতিজ্ঞা। সে যাই হোক। নামে কী এসে যায় -‘হোয়াটস ইন এ নেইম?’
আমাদের দল ছিল ভারী। আমার দু’বোন-মাধুরী, মনিকা, স্ত্রী সুমনা, সুইডেন থেকে আসা ভাগ্নি কণিকা, তার জামাই জুয়েল ও তাদের দুই মেয়ে-অঁধরা ও অহিন্দিতা, প্রতিষ্ঠা, কনক ও তাদের মেয়ে-গল্প। কী সুন্দর এক একটি নাম! আর গাড়ি চালক, তার নাম লিটন। তার কথাই বা বাদ দেই কেন। বুধবারের এক সুন্দর রৌদ্রস্নাত সকাল। ঢাকা থেকে রওনা দেই বড় একটি মাইক্রোবাসে। ভাগ্য ভালো বলতে হবে কেননা রাস্তায় খুব একটা ভিড় পাইনি। ঘন্টা আড়াই চলার পর আমাদের গাড়িটি যখন বিশাল কুমুদিনী ট্রাস্ট এলাকায় পৌছুলো তখন মনের মধ্যে এক ধরনের ভালোলাগা পেয়ে বসেছিল। যেন কত প্রতীক্ষার পর কাছে পাওয়া। এটি তো আর পাঁচ-দশটি প্রতিষ্ঠানের একটি নয়, এটি যাকে বলা যায় অন্যতম। একেবারে আলাদা, ভিন্ন, সমস্ত দিক বিচার্যে- আকারে, আয়তনে, গুণে, বলা যায় সর্বগুণে গুণান্বিতা। সর্বোপরি এমন এক দানশীল ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও জড়িত, যার নামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনীর সৈন্য ও তাদের স্থানীয় দোসররা একবার নয়, দু-দুবার বাড়ি থেকে ডেকে তাকে ও তার সন্তানকে উঠিয়ে নেয় এবং শেষের বার তাদের আর ফিরিয়ে দেয়নি। প্রথম যেদিন তুলে নিলো সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল। রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী সাহাকে গভর্নরের বাসভবনে ডেকে পাঠানো হয়। যখন তারা যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন পাক হানাদার বাহিনী তাদের তুলে নেয় এবং মোহাম্মদপুরের একটি ক্যাম্পে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নিয়ে যায়। পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ মে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এই ঘটনার পর আর পি সাহা নিজেকে অনেকটা নিরাপদ মনে করেন এবং মির্জাপুর চলে যান। সেখানে বসবাসরত হিন্দুদের আশ্বাস দেন যে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। জানা যায়, তিনি পাকিস্তান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মির্জাপুরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টে আমন্ত্রণ জানান, এইটি প্রমাণ করতে যে তারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন ও ভারতীয় এজেন্ট নন। তিন দিন পর ৮ মে কথা ছিল মির্জাপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আর পি সাহার মিটিং হবে। সেদিনই তাকে ও তার ছেলেকে পাক সেনা ও তাদের স্থানীয় দোসররা তুলে নেয়। এর পর থেকে তাদের আর কোন সন্ধান মেলেনি। ভবানী সাহা যখন তার বাবার সাথে যাবার মনস্থির করেন তখন অনেকেই তাকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ভবানী সাহা বলেছিলেন, ‘এই সময় বাবার আমাকে দরকার।’ সাহা পরিবারের এই দুঃসময়ে যে নারী কাছে, পাশে থেকে সাহস জুগিয়াছিলেন তিনি হলেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। (চলবে)

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধতেজদীপ্ত ওয়াসফিয়ার আলোয় উদ্দীপ্ত হোক আগামীর সন্তান
পরবর্তী নিবন্ধজ্বালানি সাশ্রয়ে সমালোচনা কেন