হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩০ জুলাই, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

দেশ আমার দেশ : কেন
ফিরে আসি বারবার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “যে হতভাগার বক্ষের মধ্যে ‘মন’ নামক একটা প্রাণী গর্ত খুঁড়ে বাসা করেছে তার আর বিশ্রাম নেই। মনের সন্তোষ নেই। তার পক্ষে কিছুই যথেষ্ট নয়। সে যখন জলে থাকে তখন স্থলের জন্য লালায়িত হয়, যখন স্থলে থাকে, তখন জলে সাঁতার দেবার জন্য তার ‘অসীম আকাঙ্ক্ষার’ উদ্রেক হয়।” রবি ঠাকুরের এই কথাটা আর কোন প্রবাসী ‘হতভাগার’ ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযোজ্য জানিনে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যে অনেকখানি, সে হলফ করে বলতে পারি। এই যেমন দেশে একনাগাড়ে চার সপ্তাহ কার পর ফিরে আসার দিন দুয়েক আগে অনেক রাতে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। তখন রাত দুটো। বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় এসে গা এলিয়ে দেই। লালখানবাজারের আমার এই ছোট্ট নীড়, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শহর-গ্রাম, সমস্ত কোলাহল- সব ছেড়ে আবার ফিরে যেতে হবে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে আসে। দেশের জন্যে আক্ষরিক অর্থে মন কাঁদে। ইচ্ছে করে থেকে যাই, অন্তত আরো ক’টা দিন। একটু আয়েশ করে বসি নিজ ঘরে, নিজেকে কিছু সময় দেই। নিজেকে সময় দেই- কথাটা এই কারণে বলা, দেশে আসার পর থেকেই এখানে-ওখানে, বন্ধু, আত্মীয়, কাজ, বেড়ানো এই সব করতে করতে এক সময় দেখা গেল ফিরে যাবার ঘন্টা বেজে গেল বলে। এইবার কেন জানি মনে হলো এই পিছুটান একটু বেশি করেই বাজলো বুকের মধ্যে। এই যে নিজ-বাসায় বসে আছি নির্জনে, নীরবে, এইভাবে থাকা এই প্রথম। দেশে যখনই আসতাম এখানে উঠতেন দাদা, আমাদের ভাইদের মধ্যে সবার বড়। তার সাথে আসতেন বৌদি। এবার তাদের কেউ নেই। করোনার শুরুর দিককার সময়ে হুট্‌ করে দাদা চলে গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে, কোন আগাম বার্তা না দিয়ে। দুপুরে হাসপাতাল, সন্ধ্যেয় সব শেষ, চোখের পলকে। কাছে ছিলেন কেবল বৌদি। উনিও টের পেলেন না। বুঝি দাদা ঠিক টের পেয়েছিলেন যে তার অন্তিম-যাত্রার রথ এসে দাঁড়িয়ে আছে। তা না হলে তিনি কী করে শেষ মুহূর্তে বৌদিকে বললেন, ‘আমার প্যান্টের পকেটে কিছু টাকা আছে, তা নিয়ে নাও।’ একা আঁধো -অন্ধকারে বসে আজ দু-বছর পর মনে হয়, যেন এক কোন কালবৈশাখী ঝড় হঠাৎ এসে আমাদের গোটা পরিবারের সব ওলোট-পালট করে দিয়ে গেল, একেবারে এধার থেকে ওধার। দাদার অনেক স্মৃতি আমার এই ঘরে। এখন সব ফেলে ফিরে যেতে হবে, যেখানে আমার স্থায়ী-বসবাস। ইচ্ছে করে থাকি আরো ক’টা দিন। এই যে আরো কটা দিন জন্মভূমিতে থাকার আঁকুতি, সে অন্যজন বুঝবে কী করে? নাড়ির টানকে মাড়িয়ে ফিরে যাবার কষ্ট যন্ত্রণা ব্যথা সেই সম্যক উপলদ্ধি করতে পারে, পরবাসে যার স্থায়ী বসবাস। কথায় আছে -‘কী যাতনা বিষে/ বুঝিবে সে কিসে,/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে,/যতদিন ভবে, না হবে না হবে,/তোমার অবস্থা আমার সম।/ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে/বুঝে না বুঝিবে, যতনা মম।’ আমার কথা শুনে বুঝি ঈষৎ হেসেছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। প্রতিবারের মত এবারও চট্টগ্রাম পৌঁছার ঠিক পরদিন মালেক ভাইয়ের অফিস চেম্বারে কফি খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল তার সাথে। দেশের জন্যে প্রবাসীর মন কাঁদে শুনে তিনি বলে উঠেন, ‘কথাটা ঠিক না। দেশের জন্যে মন কাঁদে ঠিক না,’ বলেই বললেন, ‘আমার কিছু বন্ধু আছে, যারা দীর্ঘদিন আপনার মত আমেরিকা-কানাডায় আছে। তারাও প্রায়শ বলে, দেশের জন্যে মন কাঁদে। যদি তাই হয় তাহলে তারা চলে আসতো। কিন্তু আসবে না, আরাম-আয়েশি জীবনের জন্যে, সুন্দর জীবনের জন্যে তারা আসবে না।’ মালেক ভাইয়ের কথাটা উড়িয়ে দেবার মত নয়। আবার পুরোপুরি মেনে নিতেও মন চায় না। আসলে কোথায় যে আমাদের ভালোলাগা বলা মুশকিল। দেশে এলে মনে হয়, আহা কী সুখ। হল্যান্ড ফিরে মনে হয় এতো অনিয়মের মাঝে কী করে দেশে এতোগুলো সময় কাটালাম। ভাবি কোথায় আমার সুখ নামক অচিন পাখিটি?
২. মানুষের মন বড় বিচিত্র। সব ছেড়ে চলে এলাম। চলে আসতে হলো। মানুষ পাখীর মত। সাইবেরিয়ার পাখি যেমন উড়ে যায় ভিন দেশে প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচতে, শস্য আহরণের জন্যে, মানুষও পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে উড়ে চলে, জীবনের প্রয়োজনে, বাঁচার প্রয়োজনে এবং নূতনকে দেখার তাড়নায়। ঢাকা থেকে দুবাই, দুবাই থেকে আমস্টারডাম। সব মিলিয়ে এগার ঘন্টা শূন্যে থাকার পর এমিরেটসের বিশাল বোয়িং ৭৭৭-৩০০ হল্যান্ডের মাটি যখন ছুঁলো তখন স্থানীয় সময় রাত আটটা। কিন্তু দিনের আলো তখনও নেভেনি। সামারে রাত নামে সাড়ে নটা-দশটা নাগাদ। শিফল এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল শ্যালিকা পূরবী ও তার স্বামী সুধীর। ক্লান্ত শরীর, গা এলিয়ে দেই। গাড়ি চলে এগিয়ে। আমস্টারডাম এয়ারর্পোঁ থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে গাড়ি পড়তেই মনে হয়, আহা কী প্রশান্তি! সুনসান নীরবতা চারিদিকে। যেদিকে তাকাই সবুজ মাঠ, তখনও মাঠে চড়ে বেড়ায় গরু, ভেড়ার দল। সারি সারি গাছ-গাছালি, অভিন্ন তাদের আকার, গঠন, যেন পটে আঁকা ছবি। কোথাও কোন হই-চই নেই, নেই যানবাহনের ভিড়, নেই দেশের মত প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে চলমান গাড়ির হর্ন বাজানো, নেই কে কাকে ছাড়িয়ে, মাড়িয়ে এগিয়ে যাবার অসম প্রতিযোগিতা। সব, সবাই চলেছে নিয়ম মেনে। মনে হয় যেন স্বর্গে প্রত্যাবর্তন। অথচ দুদিন আগেও মন খারাপ করে একা নির্জনে বসেছিলাম। মন খারাপ করেছিলাম ফিরে যেতে হবে বলে। ভাবি কী করে সমস্ত অনিয়মের ভিড়ে এতটা সময় দেশে কাটালাম। কী করে এত জঞ্জালের ভিড়েও এতো ভালো লাগলো সেখানে কাটানো সময়গুলি। একেই বুঝি বলে মনের খেলা। সে যে কি চায়, কিসে তৃপ্ত নিজেই জানে না। আবার মনে হয় একেই বুঝি বলে বুঝি মায়ের টান, জন্মভূমির টান, নাড়ির টান। এই নাড়ির টানেই আমাদের ফিরে যাওয়া, একবার নয়, বারবার।
৩. আর এক আড্ডায় পরিচয় হওয়া এক কৌতুহূলী জানতে চায় কেন ভালো লাগে এ দেশ? অতি উন্নত দেশ। ছোট্ট দেশ, কোথায় আছে ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’। ওয়েলফেয়ার স্টেটের সংজ্ঞায় সবার নাগরিক-সুবিধার অধিকার আছে। আছে নিশ্চিন্ত জীবন। সব চলে নিয়ম মেনে, আইন মেনে। এ দেশে নেই দেশের সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক থেকে শুরু করে মাস্তান আর পুলিশের হয়রানি। নেই খাবারে ভেজালের উৎপাত। ঘড়ির কাঁটা হিসেব করে আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যেতে পারেন। রাত দুটো-তিনটেয় আপনার মেয়ে বা স্ত্রী একা প্রয়োজনে বা প্রয়োজন-ছাড়া গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে পারেন। আপনাকে তার জন্যে কোন টেনশন করতে হবে না। হাতের কাছে টেলিফোন থাকলে সব কিছু হাতের মুঠোয়। একটি উদাহরণ দেই। আজ সকালে ঘুম ভাঙে টেলিফোনের শব্দে। ফোন ধরতেই উল্টো দিক থেকে এক মহিলা বলে উঠে, ‘শুভ সকাল, হাসপাতাল থেকে বলছি। আজ সকাল সোয়া ন’টায় তোমার হাসপাতালে আসার কথা ছিল। এখন সাড়ে ন’টা।’ তখনই মনে পড়ে আজ আমার চোখে ইনজেকশন নেবার কথা। বললাম, আজ তো আর হবে না, আগামীকাল কি নিতে পারি? উত্তরে জানায়, ‘না, আজ দুপুরে নিতে পারো, তা না হলে তুমি জরিমানা পাবে।’ ঠিক হলো, দুপুর আড়াইটা। বাসা থেকে হাসপাতাল কাছেই। সাইকেলে মিনিট আটেকের বেশি দূরত্ব নয়। সুন্দর রৌদ্রস্নাত দিন। গাড়ি না নিয়ে সাইকেলে রওনা দেই। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট দুয়েক আগে পৌঁছে যাই। অপেক্ষা করি, ঠিক আড়াইটায় এসিস্টেন্ট এসে নাম ধরে ডাকলে ভেতরে প্রবেশ করি। জন্ম তারিখ, কোন চোখ জানতে চাইলে। সব মিলিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ইনজেকশন দেয়া শেষ। ফিরে আসি সাইকেল চালিয়ে। এই কাজটি দেশে করতে গেলে কী গলদঘর্ম হতো সে বলা বাহুল্য।
৪. নিরাপত্তা বোধ করি সব চাইতে বেশি প্রয়োজন। জীবনের নিরাপত্তা, সন্তানদের আগামী দিনের নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিরাপত্তা- এই নিরাপত্তার বড় অভাব দেশে। একটা সময় মনে হতো বয়স একটা পর্যায়ে পৌঁছালে দেশে ফিরে গিয়ে থিতু হয়ে বসবো। বছর কয়েক আগেও এই চিন্তাটাই মাথার মধ্যে জেঁকে বসেছিল। দিন যত যাচ্ছে, বয়স যত বাড়ছে, ততই এই থিতু হয়ে বসার ইচ্ছের-জোর কমে আসছে। প্রশ্ন করতে পারেন, দেশে কি আর লোকজন নেই? দেশে কি লোকের চিকিৎসা হচ্ছে না? উত্তরে যে যা বলুক না কেন আমি বলবো, না হচ্ছে না, যেমনটি হবার দরকার তেমনটি হচ্ছে না। বিত্তবানরা হয়তো চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু ক’জনার স্কয়ার-জাতীয় হাসপাতালে যাবার সামর্থ্য আছে! এদেশে রাণী যে ধরনের চিকিৎসা পান, একজন সাধারণ নাগরিকও ঠিক একই চিকিৎসা পান। এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই সময়মতো চিকিৎসা বা সঠিক চিকিৎসা না-পাওয়ার ভীতি থেকেও অনেকের ফেরার ইচ্ছে থাকলেও স্থায়ীভাবে ফেরা আর হয়ে ওঠেনা। তবে ফিরে না তেমনটিও বলা যায় না। অনেকেই ফিরে, তবে লাশ হয়ে। সেই কবি সুকান্তের ‘মুরগীর’ মত। একটি মুরগী টেবিলের নিচে ঘুরঘুর করতো টেবিলে সাজানো খাবার খেতে। তার ইচ্ছে কখন টেবিলে উঠতে পারবে। টেবিলের খাবার খাবে। পারে না। একদিন উঠে এলো টেবিলে। তবে খাবার খেতে নয়, খাবার হিসেবে। আমার মত অনেক প্রবাসীর দেশে ফিরে আসা ঠিক মুরগিটির মত গিয়ে সমাপ্তিরেখা টানে।
পরিশেষে : এখানে এই প্রবাসে সব আছে। তারপর যেন কী নেই। এই ‘কী’-টা হলো নিকটজন, দেশ। নাড়ির টান- তাকে ক’জন উপেক্ষা করতে পারে। কেউ কেউ যে পারেন না, সে কথা শক্ত করে বলতে পারিনে। কেউ কেউ পারেন। কিন্তু তারা ব্যতিক্রম। অনেকে তো জন্মদাত্রী মায়েরও খবর নেন না। তো তারা মাতৃভূমির খবর নেবেন, তাদের কাছে তেমনটি আশা করাও ঠিক নয়। দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবনের সুখের, আনন্দের দিক যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে না-পাওয়ার দিক। এই পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝেই এগিয়ে চলে আমাদের দিনরাত্রি। এই নিয়ে আছি আমরা। আছি বেশ আছি, মনের ভেতর দেশকে নিয়ে। সবার ঋণ শোধ করা যায়, কিন্তু মাতৃভূমির ঋণ- সে কিছুতেই নয়। সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে – “I am paying everyone’s debt, but I can’t pay my motherland debt”. .

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোক দেখানো ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়
পরবর্তী নিবন্ধদল-মত যার যার প্রধানমন্ত্রী সবার