হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৬ জুলাই, ২০২২ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

শেষ রক্ষা হলো না বরিস জনসনের : কে হবেন ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী?
তীরে এসে অবশেষে ডুবলো তরী। শেষ রক্ষা হলো না বেচারা বরিসের। প্রায় বছর তিনেক আগে ‘ল্যান্ডস্লাইড ভিকট্রি’ বা ‘ভূমিধস বিজয়ের’ মধ্য দিয়ে বৃটেনের ক্ষমতায় এলেও নির্দিষ্ট মেয়াদ ফুরোবার আগেই ক্ষমতা ত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ও টোরি দলের নেতা বরিস জনসন। ক্ষমতায় বসার পর থেকেই একটির পর একটি কেলেঙ্কারির সৃষ্টি করতে থাকেন লন্ডনের দু-দুবার মেয়র হওয়া এই বৃটিশ রাজনীতিবিদ। যে সমস্ত কেলেঙ্কারি তিনি ঘটিয়েছেন, অন্য কোন রাজনীতিবিদ হলে অনেক আগেই তাদের ক্ষমতা ছাড়তে হতো। কিন্তু বরিস জনসন তার রাজনৈতিক কৌশল, দক্ষতা ও বাগ্মিতার কারণে বারবার ‘উৎরে’ গেছেন। তার ‘ফান-লাভিং’ ও ‘আফবিট ইমেজ’ এবং ভোটারদের মুগ্ধ করার দক্ষতা টোরি দলকে অনেক এগিয়ে নিয়েছিল। নির্বাচন ছাড়াই তিনি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং এর চার মাস পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টোরি দলের জন্য বিশাল জয় ছিনিয়ে আনেন। এমন কী যে সমস্ত এলাকায় আগে টোরি দল কোন আসন পায়নি, সেখান থেকেও দলকে বিজয়ী করে আনেন। ২০২০ সাল নাগাদ নিজ দল ও বৃটিশ রাজনীতিতে তার অবস্থান অনেক শক্তিশালী রূপ ধারণ করে। তার দলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মত তেমন কোন নেতৃত্ব ছিল না। এমন যখন তার রাজনৈতিক অবস্থান, তখন অনেকটা ‘কাল’ হয়ে আসে ‘করোনা ভাইরাস’। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলির মধ্যে কোভিডের কারণে মৃত্যু সংখ্যা বৃটেনে সব চাইতে বেশি। তারপর এলো ‘পার্টি গেইট’ কেলেঙ্কারি। প্রায় ৬০ জন দলীয় আইনপ্রণেতা ও সরকারি কর্মকর্তা তার সামপ্রতিক কেলেঙ্কারির কারণে পদত্যাগ করলে বরিস জনসনের বিদায়ের ঘন্টা বাজতে শুরু করে। ক্ষমতায় বসার পর থেকে একটির পর একটি কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে বরিস জনসন বিতর্কিত ও কোন কোন ক্ষেত্রে নিন্দিত হন।
সমপ্রতি বরিস জনসন যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত এম পি ক্রিস পিনচারের ব্যাপারটি যেভাবে ‘হ্যান্ডেল’ করেছেন তার জন্যে তিনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। চুয়ান্ন বছর বয়েসী এই আইন প্রণেতা শেষে গত ৩০ জুন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। জনসনও অবশেষে ক্ষমা চান এই বলে, পিনচারকে সরকারে নিয়োগ করা ছিল ভুল।
তারপর তথাকথিত ‘পার্টি গেইট কেলেঙ্কারি’। ‘কোভিডের’ কারণে তার সরকারের প্রণীত বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করে বরিস জনসন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ‘অবৈধ পার্টির’ আয়োজন করেন। ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে প্রথমে তিনি এমন কিছু ঘটেছে বলে সরাসরি অস্বীকার করেন। কিন্তু এরপর বলেন, ঘটে থাকলেও তাতে আইন ভঙ্গ হয়নি। তবে পাশাপাশি এও বলেন যে, সেটি ছিল ভুল। কথা কিন্তু একই। তার এমন আচরণে বৃটিশ জনগণের মাঝে অসন্তোষ বাড়ে, কারণ এই ‘পার্টি’ এমন সময় অনুষ্ঠিত হয়েছিল যখন খোদ রানী এলিজাবেথকে দেখা যায় স্বামী প্রিন্স ফিলিপের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে গির্জায় বেঞ্চে নিকট-পরিজন বেষ্টিত না হয়ে একাকী নীরবে বসে থাকতে। যেখানে দেশের রাণী সরকার-প্রণীত নিয়ম ভঙ্গ করেননি সেই ক্ষেত্রে দেশের প্রধানমন্ত্রী একই আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সহকর্মী ও কাছের লোকদের নিয়ে ‘মউজ’ করছেন। এটি কেউ ভালোভাবে নেননি। বৃটিশ পুলিশ লকডাউন আইন ভাঙার অপরাধে বরিস জনসনকে জরিমানা করে। বরিস জনসন হলেন বৃটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি পুলিশের কাছ থেকে জরিমানা পান। কেলেঙ্কারি এখানেই শেষ নয়। ২০১৯ সালে যখন ‘ব্রেক্সিট ক্রাইসিস’ তুঙ্গে তখন বরিস জনসন রানী এলিজাবেথকে পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেবার অনুরোধ জানান। বৃটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার ডেডলাইনের কাছাকাছি সময় এই পদক্ষেপটি নেয়া হয়েছিল এবং জনসন সেই সময় কীভাবে এবং কখন ই ইউ থেকে বেরিয়ে যাবেন সে বিষয়ে সংসদের সাথে চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই সমস্ত পদক্ষেপ বরিস জনসন নিয়েছিলেন অনেকটা গায়ের জোরে এবং সেই সময় সুপ্রিম কোর্ট এই বলে ঘোষণা দেয় যে, বরিস জনসন সরকার বন্ধ করার অনুমোদনের জন্যে বেআইনী ভাবে কাজ করেছেন এবং বেআইনী পদক্ষেপ নেবার জন্যে রানীকে বিভ্রান্ত করেছেন। জনসন পরে রানীকে বিব্রত করার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।
প্রশ্ন- এতো কেলেঙ্কারির পরও গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত দেশ বৃটেনে একজন প্রধানমন্ত্রী কী করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন? এর সহজ উত্তর টোরি বা কনজারভেটিভ পার্টিতে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তেমন কোন শক্ত নেতা নেই। জাতীয় নির্বাচন খুব বেশী দূরে নয়। অন্যদিকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে, বিশেষ করে রাশিয়ার ইউক্রেন-আগ্রাসনকে ঘিরে। এমন পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ আইন-প্রণেতা চাননি দলে কোন বিপর্যয় নেমে আসুক। তারপরও বরিস জনসনকে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে হয়। সে ভোটে দলের ১৪৮ এমপি তার নেতৃত্বে অনাস্থা জানিয়ে ভোট দেন। সে যাত্রায় বরিস জনসন টিকে যান। কেননা তার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ২১১ জন এমপি। তা সত্ত্বেও দলের ৪১% আইনপ্রণেতা বিপক্ষে ভোট দিলে দলের মধ্যে তার অবস্থান বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধরে নিয়েছিলেন এবার হয়তো বরিস জনসন পদত্যাগ করবেন। তেমন দাবি উঠেছিল বিরোধী দল থেকে তো বটেই, খোদ নিজ দল থেকেও। এই অনাস্থা ভোটের পর দলের অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বরিস জনসনের যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে এবং দেরীতে হলেও বরিস জনসন পদত্যাগ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন। তবে দলে নতুন নেতৃত্ব না আসা পর্যন্ত তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানান।
বরিস জনসন লড়েছিলেন ব্রেক্সিটের জন্যে। তিনি চেয়েছিলেন বৃটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনতে এবং বৃটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে আসে। স্বভাবতই ইউরোপীয় ইউনিয়নে বরিস জনসন জনপ্রিয় ও সমাদৃত নন। জার্মানির টেবলয়েড পত্রিকা ‘বিল্ড’ লিখেছে, Borexit অর্থ ‘বরিস এক্সিট’। পাশাপাশি ইংরেজিতে এই বহুল-পঠিত পত্রিকা লিখেছে, ‘বাই বাই বরিস’। অর্থাৎ তারা বরিসের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়াতে উৎফুল্ল। কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে নয়, বরিস জনসন ইউরোপীয় মিডিয়ার কাছেও প্রিয়ভাজন নন। এদিকে বিরোধী লেবার পার্টি কোন কালক্ষেপণ না করে এখনই বরিস জনসনের পদত্যাগ দাবি করে। লেবার পার্টি গেল বুধবার হাউস অব কমন্সে, তাকে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বের করে দেবার জন্যে অনাস্থা ভোটের দাবি জানায়, যা বরিস জনসন ‘ঠেকিয়ে’ দেন। এই ভোটে লেবার পার্টি জিতলে জাতীয় নির্বাচন হতো। কিন্তু সেটি হলো না। তার এই ‘পদক্ষেপকে’ লেবার পার্টি ক্ষমতার অপব্যবহার বলে আখ্যায়িত করে।
এমন যখন পরিস্থিতি তখন অন্যদিকে চলছে টোরি দলের অভ্যন্তরে আগামী-নেতৃত্বের লড়াই। কে হবেন বরিস জনসনের উত্তরসূরী? ইতিমধ্যে ১১ প্রার্থী দলীয় নেতৃত্বের জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা যায়। এদের মধ্যে অন্যতম ভারতীয় বংশোদ্ভূত সমপ্রতি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনক, যদিওবা তিনি কিছুদিন আগেও তার স্ত্রীর ট্যাক্স-ইস্যুতে সমালোচিত হয়েছিলেন এবং তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। তবে মনে হয় সে পরিস্থিতি থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন এবং দলের মধ্যে তিনি ইতিমধ্যে বেশ কিছু সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। যদি নির্বাচিত হন, তবে তিনি হবেন বৃটেনের প্রথম নন-ইংলিশ প্রধানমন্ত্রী। এরপর আছেন বৃটেনের প্রথম মহিলা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পেনি মোর্দান্ড, দলের তৃণমূল পর্যায়ে তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার সাথে সু-সম্পর্ক ছিলনা বরিস জনসনের। প্রধানমন্ত্রী হবার কিছুদিন পর বরিস তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন। ২০১৯ সালে টোরি পার্টির নেতৃত্বের লড়াইয়ে জনসনের প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমী হান্টকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। হয়তো সে কারণে। দলীয় নেতৃত্বের লড়াইয়ে এরপর রয়েছেন ৪৬ বছরের প্রথম মহিলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। বরিস জনসন-অনুগত অনেকই তাকে সমর্থন দেবেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। নেতৃত্বের লড়াইয়ে প্রথম সারিতে আছেন জেরেমি হান্ট, যিনি বরিস জনসনের একজন কট্টর সমালোচক এবং বরিস জনসনের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা ভোটকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব লড়াইয়ে তিনি বরিস জনসনের কাছে হেরে যান।
লড়াইয়ে আরো আছেন পাকিস্তান বংশোদ্ভূত সাজিদ জাভেদ (৫২)। তিনি বরিস জনসন মন্ত্রিসভার প্রথম সদস্য যিনি সবার আগে এই ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন যে ‘এই সরকারের সাথে কাজ করে যেতে তার বিবেক তাকে বাধা দিচ্ছে।’ আরো যারা টোরি দলের নেতৃত্বে নাম লিখিয়েছেন তারা হলেন ৪২ বছর বয়েসী কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা কেমি বাডেনচ, নব-নির্বাচিত চ্যান্সেলর নাদিম জাহাবি, এটর্নি জেনারেল সুয়েলা ব্রেভারমান ও রেহমান চিশতী। দেখা যাক কার হাতে টোরি দলের নেতৃত্ব গড়ায়? কে হয় বৃটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী? সেদিনের অপেক্ষায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির প্রবক্তা মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ