হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

সুইজারল্যান্ডের চিঠি
বড় বিচিত্র মানুষের মন (শেষ পর্ব)

গেল সংখ্যায় এসে থেমে ছিলাম এই বলে, বিপুল এই বিশ্বের কতটুকুই বা জানি। কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমরা। সেটি নতুন করে টের পাই যখন অসীম কোন সমুদ্রের ধারে কিংবা বিশাল পাহাড়ের কাছে এসে দাড়াই। তেমনি পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা পাহাড়ের পাশ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে এই কথাটি নতুন করে মনে পড়ে। কোথাও পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাড়ি-চলার পথ, কোথাও বয়ে-চলা নদীর পাশ ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। নিপুর সুইস মা-বাবার বাড়ি ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে। সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে একটি উঁচু পাহাড় দেখিয়ে নিপু বলে, “এই উঁচু পাহাড়টায় পায়ে হেঁটে উঠতে সময় লাগে এক ঘন্টা ৪০ মিনিট। নানা কারণে যখন মন খারাপ থাকে তখন এই পাহাড়ে উঠে বসে থাকি। ফেলে আসা দিনের কথা মনে করি, কাঁদি, কেঁদে মনকে হালকা করার চেষ্টা করি। তারপর এক সময় ধীরে ধীরে ফিরে আসি ডেরায়।” পাহাড়ে উঠার কারণ শুনে মনটা খারাপ হয় বটে, তবে সে যে এই পাহাড়ে একা একবার নয়, অনেকবার উঠেছে, সে কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে ভয়ে। ‘কী ভয়ংকর দুঃসাহসী মেয়েরে বাবা’, শুনে আমি বলি। এক পর্যায়ে আমরা পৌঁছে যাই চমৎকার একটি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির সামনে। পাশে বাগান। একদিকে বাংলাদেশি সব্জি, টের পাই এ নিপুর কাজ। বলে, অবসরে এখানে এসে বাগানের কাজ করি। দেশিয় লাউ থেকে বেগুন ইত্যাদি। বয়সের কারণে তার মা-বাবার পক্ষে বাগান করা সম্ভব না। নিপু বাসার ভেতরে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসে। হয়তো ভেতরে গিয়ে বলে এসেছে, আমরা এসেছি। ভেতরে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা। টের পাই ইনিই নিপুর মা। বয়স আনুমানিক সত্তরের কাছাকাছি কিংবা সামান্য বেশি। দেখে বুঝা মুশকিল। এই বয়সেও কী মাধুরী-মেশানো সৌন্দর্য্য। একটু অবাক হই তার হাতে শেভ করার রেজর দেখে। তাকে ফুলের গোছা দিতে গেলে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ওকে (স্বামীকে) শেভ করাচ্ছিলাম। সন্ধ্যেয় জনা কয়েক অতিথি আসবেন। সে কারণে। ফুলের তোড়া নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাদের ভেতর নিয়ে গেলেন। সেখানে ইজি চেয়ারে বসে আছেন তার স্বামী। মুখে তখনও শেভিং ক্রীম। এখন চলা-ফেরা করতে পারেন না। দুজনেরই বয়স হয়েছে। কিন্তু মহিলাকে দেখে মনে হয় স্বামীর তুলনায় তিনি বেশ শক্ত। নিপুকে সন্তানের মত কাছে টেনে নেবার জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানাই। বলি, আসার পর থেকে নিপুর কাছে কেবল আপনাদের কথা শুনছি। মহিলা মৃদু হাসেন। তার সাথে ছবি নেই। ক্ষণিক বাদে বিদায়। কেননা আমাদের তাড়া, ফিরতে হবে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে নিপু যখন বললো, ‘চলুন আপনাদের নিয়ে বার্ন যাই, সেখান থেকে সরাসরি জেনেভাগামী ট্রেন ধরতে পারবেন’, তখন আমার ‘না’ করার কোন কারণ ছিলনা। এই ফাঁকে সুইজারল্যান্ডের রাজধানীও দেখা হয়ে গেল। এর আগে এ দেশে অনেকবার আসা হলেও রাজধানী বার্ন যাওয়া হয়নি। নিপুর গাড়ি দ্রুতগতিতে পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা পথ ধরে নিচের দিকে নামতে থাকে। লক্ষ্য বার্ন।
বার্ন এসে গাড়ি থেকে নেমে দেখা মেলে ভিন্ন এক শহরের। যেন স্পিজের ঠিক উল্টো পিঠ। লোকজন, পথচারী, গাড়ি, বাস গিজগিজ করছে। ইউরোপের আর অন্য পাঁচ দশটা শহরের মত ব্যস্ত। স্টেশন-লাগোয়া শপিং সেন্টার। নিপু অতি উৎসাহে এদিক-ওদিক দেখাতে চায়। কিন্তু আমার ভেতরে তাড়া। কোন কারণে ট্রেন মিস করতে চাইনে। আজই ফিরে যেতে হবে জেনেভা। কাল বিকেলের ফ্লাইটে হল্যান্ড ফেরত। দুপুরে বাসা থেকে বের হওয়া অবধি চা-কফি খাওয়া হয়নি। কফি অবশ্য আমার অপছন্দের তালিকায়। স্টেশনের ভেতর বিশাল এলাকা জুড়ে শপিং কমপ্লেক্স। হরেক-রকমের দোকান। বেছে বেছে একটি কফি শপে বসে চা-কফি, কেক খেয়ে ক্ষণিক আড্ডা চলে। নিপু তার মেয়ের কথা বলে। দেশের কথা বলে। টের পাই সুইজারল্যান্ড থাকলেও এবং যতই না সুইস সমাজের সাথে মিশে যাক না কেন, এখনো মন পড়ে রয়েছে দেশে, মেয়ের কাছে। দেশের সাথে যে নাড়ির টান। এক সময় এগিয়ে যাই প্লাটফর্মের দিকে। নির্দিষ্ট সময়ে এলো ট্রেন। আমাদের ফেরার পালা। পা-ছুঁয়ে নিপু প্রণাম করতে যায়। বাঁধা দেই। ট্রেনের ভেতর কাঁচের জানালা দিয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা নিপুকে ইশারা করি চলে যাবার জন্যে। সে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃদু হাত নাড়ে। টের পাই তার চোখের কোনায় একটি-দুটি অশ্রুজল। দুদিনেরও কম সময়ে মানুষ কত আপন হতে পারে। মানুষের মন বড় বিচিত্র।
কথা ছিল জেনেভা ফিরে আগের হোটেলেই উঠবো। সেভাবে বলে রেখেছিলাম। আবার ঠিক করলাম আর একটি রাত তো মাত্র, সেটি ভাগ্নি রিমির বাসায় থেকে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেব। রিমি, তার বর সসীম অনেকবার বলেছিল ওদের বাসায় থাকতে। থাকার আলাদা কামরাও আছে। বছরে বার-দুয়েক আসা হয় জেনেভায়। কিন্তু ভাগ্নি রিমির বাসায় থাকা হয়না, যদিও বা প্রতিবারই শত ব্যস্ততায়ও খেতে হয়েছে সেখানে। এমনও হয়েছে খেতে যেতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা বেজে গেছে। কিন্তু রিমি, তার স্বামী সসীম নাছোড়বান্দা এবং ফি-বারই বিশাল আয়োজন। এবার বলে রেখেছিল ওদের ওখানে থাকতে হবে। শেষে বললাম, ঠিক আছে, কাজ শেষে একরাত তোমাদের বাসায় থাকা যাবে। তোমাদের মেয়ের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে। কিন্তু স্পীজ থেকে ফেরার পথে ট্রেনে মনে হলো, সেখানে গিয়ে ডিনার সেরে হোটেল ফিরে আসবো। যেই না কথাটা ফোনে সসীমকে বলা হলো, সে অভিমানের সুরে বলে উঠে, ‘ঠিক আছে মামা, আপনাদের কষ্ট করে খেতে আসারও দরকার নেই। আপনারা হোটেলেই যান’। কথা না বাড়িয়ে জেনেভা নেমে ট্রাম নিয়ে চলে যাই তার বাসায়। সুন্দর ছিমছাম, অনেকটা নিরিবিলি এলাকায় দোতলায় বাসা। ছোট্ট মেয়ে, এলিনা, বয়স তিন, কিন্তু এই বয়সেই বেশ কথা বলতে চায়। আমাকে ডাকে ‘হোটেল দাদু’, কারণ বাইরে গেলে আমার থাকা হয় হোটেলে। তবে তার তো তা জানার কথা নয়। তাকে তোতা পাখির মত শিখিয়েছে হল্যান্ড থেকে আসা তার দিদিমা, সুমনা। খাবার টেবিলে চলে গল্প। এলিনা আমার পাশে, আমার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে। ভালো লাগে, মিষ্টি মেয়েটি।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ি। নিকোলাকে দেখতে। নিকোলার কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম এই লেখা। বাংলাদেশ ও প্রকৃতি-প্রেমী নিকোলা ফুরে সুইজ উন্নয়ন সংস্থা, আর্থ ফোকাস ফাউন্ডেশনের এঙিকিউটিভ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আশি বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু তারপরও ভীষণ সক্রিয় ছিলেন মরণের আগ তক। দুপুরে হাসপাতালে তাকে দেখতে যাই। হল্যান্ড ফিরে আসার দুদিন পর সংবাদ পাই নিকোলা আর নেই। সে সংবাদটি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিল তার মেয়ে। নিকোলা ছিল মরণ শয্যায়। মৃত্যুর দিন নয়, মুহূর্ত গুণছে। সেটি তারও জানা। অথচ ওই দশায় আমাকে দেখে মৃদু কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে বলে, ‘সরি, বিকাশ, আই এম সরি।’ “সরি” এই কারণে বলছিল, সে কথা দিয়েছিল জেনেভায় আমার ৩০ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু মরণ ব্যাধির কারণে সে পারেনি। নিকোলা নেই। কিন্তু তার শেষ কথাগুলি এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে- “বিকাশ আই এম সরি”। নিকোলার আত্মা শান্তিতে থাকুক এই প্রার্থনা করি।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর মর্যাদা ও নারীবাদিতা
পরবর্তী নিবন্ধজনগণের সঞ্চয় ও অভিশপ্ত বিনিয়োগ