হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১ মে, ২০২১ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

গণহত্যা- আর্মেনিয়া থেকে বাংলাদেশ-চাই বিশ্ব স্বীকৃতি
আজ থেকে ১০৬ বছর আগে আর্মেনিয়ায় যে গণহত্যা হয়েছিল তা চলতি সপ্তাহে পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২৪ এপ্রিল ‘আর্মেনিয়া গণহত্যা স্মরণ দিবস’ উপলক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তুরস্কের ‘অটোমান’ শাসনামলে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে ঘোষণা দেন। এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্ট আর্মেনিয়া হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে ঘোষণা দিলেন। এর আগে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে ঘোষণা দেননি। যদিও বা বিশ্বের ৩০টি রাষ্ট্র এবং ঐতিহাসিকরা ইতিমধ্যে একে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাইডেনের এই ঘোষণায় যা ধারণা করা হয়েছিল তাই হলো। সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ জানালো তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই মন্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, ‘আমরা তার এই মন্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করি। এই ধরনের বক্তব্য আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের ব্যাঘাত ঘটাবে’। এর আগে দিনটি উপলক্ষে দেয়া এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, “প্রতি বছর আমরা অটোমান শাসনামলে যে সমস্ত আর্মেনীয় নাগরিক মারা গিয়েছিলেন তাদের স্মরণ করি এবং পাশাপাশি এই প্রতিজ্ঞায় পুনরায় আবদ্ধ হই যে এই ধরণের হত্যাযজ্ঞ যেন আর না ঘটে। আজ থেকে ১০৬ বছর আগে যে সকল আর্মেনীয় হারিয়ে গেছেন তাদের আমেরিকার জনগণ সম্মান করেন”। তিনি আরো বলেন, ‘১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল অটোমান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপলে আর্মেনীয় বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিটি নেতাদের গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে অটোমান কর্তৃপক্ষ ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় নাগরিককে স্থানচ্যুত করেছিল এবং হত্যা করেছিল”। ঠিক একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের মত, সাধারণ নাগরিক থেকে দেশের বুদ্ধিজীবী। সে প্রসঙ্গে একটু পর আসছি।
এবার একটু ফিরে তাকাই, দেখি কী ঘটেছিল আর্মেনিয়ায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ১৬ থেকে ১৯ শতাব্দীতে পূর্ব আর্মেনিয়া ও পশ্চিম আর্মেনিয়া অটোমান ও পার্সীয় সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ঊনিশ শতাব্দীর দিকে রুশ সাম্রাজ্য পূর্ব আর্মেনিয়া দখল করে নেয় এবং পশ্চিম অংশ চলে যায় অটোমান শাসকদের অধীনে। এরপর ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান শাসনামলে প্রায় ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় নাগরিককে পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগতভাবে হত্যা করা হয়, যা ‘আর্মেনীয় গণহত্যা’ হিসাবে পরবর্তীতে বিশ্বে পরিচিতি ও স্বীকৃতি লাভ করে। এদিকে ১৯১৮ সাল নাগাদ রুশ-বিপ্লবের পর রুশ-সাম্রাজ্যের পতন হলে এর অধীনে যে সমস্ত ‘নন-রুশ’ দেশ ছিল তারা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যার ফলশ্রুতিতে ‘রিপাবলিক অব আর্মেনিয়ার’ জন্ম ত্বরান্তিত হয়। এর মাঝে আরো অনেক চড়াই-উৎরাই পার হবার পর ১৯৯১ সালে যখন বৃহৎ সোভিয়েত ইউনিয়নে ধস নামে তখন আজকের ‘রিপাবলিক অব আর্মেনিয়া’ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।
অটোমান শাসনামলে সংঘটিত এই ঘৃণ্য ‘গণহত্যা’ একটি সেনসিটিভ ইস্যু যা আজকের আধুনিক তুরস্ক যার উত্থান এই অটোমান সাম্রাজ্য থেকে, পাশাপাশি তুরস্কের বর্তমান নেতৃত্ব কোনভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ‘গণহত্যাকে’ অস্বীকার করে তারা বলেন, ‘তেমনটি ঘটেনি। কিছু হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বটে, তবে তাতে উভয়পক্ষের লোক মারা গিয়েছিলেন’, যার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা মেলে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যারা হত্যাকাণ্ড ঘটায় তারা কখনো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বীকার করে না যে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সে বাংলাদেশে একাত্তর বলি, আর রুয়ান্ডা কিংবা বসনিয়ায়। কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ দখলদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ড বলি। আয়তনে ইন্দোনেশিয়ার চাইতে অনেক ছোট দেশ হল্যান্ড দীর্ঘদিন ইন্দোনেশিয়াকে তাদের দখলে রেখে শাসন ও শোষণ দুই-ই করেছিল। ইন্দোনেশীয়রা স্বাধীনতা চাইলে তাদের কঠোর হস্তে দমন করেছিল ডাচ দখলদার বাহিনী। ফলাফল অনেক নিরীহ ইন্দোনেশিয়া নাগরিককের মৃত্যু। এক পর্যায়ে হল্যান্ডকে ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে চলে আসতে হয়। কিন্তু তারা যে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তা অনেক বছর নানা প্রতিবাদ ও দাবির মুখে মেনে নেয়নি। মাত্র বছর কয়েক আগে ডাচ সরকার তাদের কৃত অপরাধ স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে। একই ভাবে তুরস্কও এখনো পর্যন্ত অটোমান-আমলে ‘আর্মেনীয় গণহত্যাকে’ অস্বীকার করে চলেছে। অস্বীকার করে চলেছে ইতিহাসকে। তুরস্ক বলে, সে সময় দুই পক্ষই- তুর্কী ও আর্মেনীয় নাগরিক হতাহত হয়েছিল। কিন্তু একদিন না একদিন তাদের সত্যকে মেনে নিতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ গড়ে উঠছে।
আর্মেনীয় হত্যাযজ্ঞকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কর্তৃক ‘গণহত্যা’ হিসাবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয় প্রতিবাদ জানাতে। তুরস্কের ডেপুটি পররাষ্ট্র মন্ত্রী সাদাত ওনাল রাষ্ট্রদূত ডেভিড সাটারফিল্ডের সাথে আলাপকালে তুরস্কের মনোভাবের কথা জানিয়ে দেন। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবীর আন্তর্জাতিক আইনের কোন ‘লিগ্যাল গ্রাউন্ড’ নেই এবং এই বক্তব্য তুর্কী জনগণকে আঘাত করেছে, একটি ক্ষত সৃষ্ট করেছে যা আমাদের সম্পর্ককে ক্ষতি করবে’। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২০২০ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ক্ষমতায় এলে তিনি আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে ঘোষণা দেবেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ একই আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু তারা ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে ‘ব্যাপক নৃশংসতা’ ও ‘ব্যাপকহারে হত্যা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন। তুরস্ককে না ক্ষেপানোর জন্যে তারা ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ শব্দটি এড়িয়ে গেছেন। তুরস্ক ন্যাটোর মিত্র দেশ। সন্ত্রাস মোকাবেলায় পশ্চিমের তুরস্ককে প্রয়োজন। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও তুরস্ককের গুরুত্ব অনেক। অন্যদিকে তুরস্ক বরাবর হুমকি দিয়ে আসছিল এই বলে, কোন দেশ আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে ঘোষণা দিলে তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন সাহস পায়নি, সাহস করে সত্যি কথাটাকে দিনের আলোয় মেলে ধরার। যে শব্দটি ব্যবহার করার সাহস ওবামা ও বুশ পাননি, সেইটি করলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি ঠিক জানতেন তুরস্ক নাখোশ হবে। তিনি এর আগে বলেছিলেন, ‘অন্যায় ঘটনায় নীরব থাকা মানে অন্যায়ের সহযোগী’। অন্যদিকে ২০১৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেট আর্মেনীয় ‘গণহত্যা’ মর্মে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাতে সম্মত ছিলেন না। তার সাথে ‘স্বৈরাচার’ হিসাবে পরিচিত তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ছিল ভালো সম্পর্ক, যেমনটি তার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে। উল্লেখ্য, ‘আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে ইতিমধ্যে যে ৩০টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, গ্রিস, ইতালী, লেবানন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, লুঙ্মেবুর্গ, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, ছিলি, চেক রিপাব্লিক এবং যুক্তরাষ্ট্র।
ফিরে আসি একাত্তরে। আজ থেকে ১০৬ বছর আগে তুরস্কে সংঘটিত ‘আর্মেনীয় গণহত্যায়’ মারা গিয়েছিল ১৫ লক্ষ লোক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল ৩০ লক্ষ বাঙালিকে, প্রায় আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছিল তারা, প্রায় এক কোটি লোক গৃহহারা হয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সংখ্যার বিচার্যে কোন গণহত্যার গুরুত্ব বাড়ে বলে মনে করিনে। সব হত্যা এবং সব হত্যার স্বীকৃতি যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি সব হত্যার বিচার হওয়া জরুরি। কেননা হত্যার বিচার না হলে, হত্যাকারী যদি পার পেয়ে যায় তাহলে আর একটি কিংবা ততোধিক হত্যাকাণ্ড যে ভবিষ্যতে ঘটবে তা অবধারিত। একাত্তরের গণহত্যার বিচার হয়নি বলে আমরা এরপরও পাকিস্তানে দেখেছি বেলুচদের হত্যাকাণ্ড, দেখেছি সে দেশে সংখ্যালঘু খৃস্টান, আহমদিয়া ও হিন্দু সমপ্রদায়ের উপর অত্যাচারের ঘটনা। অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। যদি করা হতো তাহলে একাত্তর-পরবর্তী সময়ে এই ধরনের অত্যাচার, হত্যা ঘটনা ঘটতো না। সময় এসেছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত পাক-হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে বিশ্ব-স্বীকৃতির জন্যে বিশ্ব-জনমত গড়ে তোলা এবং এই লক্ষ্যে কাজ করা। সে উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে এবং প্রবাসে বাংলাদেশি ডায়াসপোরাদেরকে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আর্মেনীয় গণহত্যার বিশ্ব-স্বীকৃতির জন্যে প্রবাসী-আর্মেনীয়দের অবদান সবচাইতে বেশি। যে কাজটি আর্মেনীয়রা করে চলেছে এখনো, একশত বছর পরেও তা আমরা কেন বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছরেও করতে পারবো না তার কোন কারণ দেখছিনে। তবে কেবল স্বীকৃতি আদায় করলেই চলবে না। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে অপরাধী রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি। তারপরও কথা আছে- ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’। তা করতে না পারলে এই যে ত্রিশ লক্ষের আত্মাহুতি তা বিফলে যাবে এবং আমরা আমাদের বিবেকের কাছে, জাতির কাছে দায়ী থাকবো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেহনতি মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধ৭ বছরের নাতি নিহত, দাদী আহত