হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

করোনার করুণা বর্ষিত হোক, কেটে যাক এই অন্ধকার অনিশ্চয়তা
‘করোনা’ যে কবে আমাদের উপর তার ‘করুণা’ বর্ষণ করবে সে একমাত্র ‘তিনিই’ জানেন। গোটা মানবজাতি ঢাকা পড়ে আছে এক ঘনঘোর অমাবস্যায়। কবে যে এই অন্ধকার দূর হবে তা কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না। না পারছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানী, না পারছে রাষ্ট্রযন্ত্র। এক অদৃশ্য শক্তি গোটা মানবজাতিকে প্রায় সোয়া বছর সম্পূর্ণভাবে কাবু করে রেখেছে। বিশ্বের এক প্রান্তে যখন একটুকু আশার আলো দেখা দেয়, তখনি অন্য প্রান্তে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এই অদৃশ্য শক্তি, ‘করোনা’। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘরের মধ্যে এক ধরনের বন্দী। অসহনীয় ব্যাপার। মাঝে মধ্যে অফিস যাই, প্রয়োজনীয় ফাইল বাসায় এনে চলে কাজ। ড্রয়িং রুমের ডাইনিং টেবিল পরিণত হয়েছে অফিস-টেবিলে। ল্যাপটপ থেকে শুরু করে দুনিয়ার কাগজপত্র, অবসরের পড়ার বই। চায়ের মগ, পানির গ্লাস। দিনের আট ঘণ্টারও বেশি সময় ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকা, টাইপ করা, মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া। ফলে মাস খানেক ধরে ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। এটিকে এখানে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় মাউস আর্ম’ অর্থাৎ ‘মাউস বাহু’, মাউসের কারণে কাঁধ থেকে গোটা হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। হাত বদল করে সপ্তাহ দুয়েক বা-হাতে মাউস নিয়ে কাজ করতে থাকি। এখনো করছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অগত্যা ডাক্তারের শরণাপর্ণ হওয়া। ডাক্তার ডাচ তরুণী। তার মুখ সাঁটা, আমারও, ‘মাস্ক’ দিয়ে, করোনার ভয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে চেম্বারে অপেক্ষা করছি। নিয়মমাফিক ওয়েটিং রুমে এসে ডেকে নিয়ে গেলেন তার চেম্বারে। দরজা ভেজিয়ে জানতে চাইলেন আগমনের হেতু। শুনে বললেন, ‘পর্দার এদিকটায় আসুন। উপরের কাপড় অর্থাৎ শার্ট খুলুন’। মহা সমস্যা। তরুণী ডাক্তার, নতুন জয়েন করেছেন। সসংকোচে শার্ট খুলি। প্রায় বছর দশেক আগে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে, পেটের কমপ্লেইন নিয়ে। ডাক্তার পাঠালেন ‘একো’ যেখানে করা হয় সেই ডিপার্টমেন্টে। প্রায় অন্ধকার কামরা। সেখানে অপেক্ষমান দুটি ডাচ তরুণী। ওদের একজন বলে, ‘সব কাপড় খুলুন’। দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে মনে বলি, বলে কী। শার্ট, গেঞ্জি, মৌজা সব খুলে কামরায় পাতানো বেডে গা এলিয়ে দিতে গেলে, তাড়াতাড়ি দুই তরুণীর একজন বলে উঠে, প্যান্টও খুলতে হবে। মনে মনে বলি, ধরণী দ্বিধা হও। প্যান্ট যে আগে খুলিনি তেমন তো নয়, অন্তর্বাসও খুলেছি, কিন্তু তাই বলে অপরিচিত তরুণীর সামনে, আধো-অন্ধকার কামরায়? তাও একজন নয়, দুই দুই তরুণীর সামনে। আমার গলা শুকাবার আগেই একজন বলে উঠলো, কেবল প্যান্ট খুললে চলবে। তারপর শুইয়ে দিয়ে পেটে ‘জেল’ লাগিয়ে স্ক্রীনে দেখতে লাগলো ওরা দুজন। ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড শীত, তার উপর ঠাণ্ডা ‘জেল’। অথচ আমি যেন ওই শীতেও ঘামতে থাকি। সে যাক- মহিলা ডাক্তার হাত এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা করলেন। শেষে বললেন, সমস্যা আপনার ‘বসায়’ অর্থাৎ আপনি কোথায় বসছেন, টেবিল ও চেয়ারের উচ্চতা, দূরত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে এটি হচ্ছে। কাজের টেবিল একখানা আছে সে তিন তলায়,পড়ার ঘরে। সিঁড়ি বেয়ে সেখানে একবার উঠলে আর নামতে ইচ্ছে করে না। সাংবাদিক বন্ধু নাসিরুল হক দেশ থেকে বার দুয়েক হল্যান্ড এসেছিলেন আমার আমন্ত্রণে। দিন কয়েক ছিলেন আমার এই বাসায়। সারাদিন আড্ডা নিচ তলায় ড্রয়িং রুমে। রাতে খাবার শেষে তার শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল তেতলায়, পড়ার ঘরের পাশের ছোট্ট কামরায়। ভারিক্কী শরীর নিয়ে উঠতে গিয়ে তিনি প্রায় প্রতিদিন বলতেন, ‘তোমাদের এই হিমালয় পাহাড় বাইতে বাইতে আমার জান শেষ’। তার শরীরে যে চর্বির পরিমাণ বেশি সে তিনি প্রথম টের পেয়েছিলেন সীতাকুণ্ড গিয়ে। তখন তিনি দৈনিক আজাদীতে সাংবাদিকতা করছেন। আমাদের দুজনের ‘কমন’ সাংবাদিক বন্ধু, সালিম সামাদ সহ আমরা তিনজন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠেছিলাম। আঁকাবাঁকা, আধাপাকা সিঁড়ি বেয়ে আমি, সালিম সহজেই উঠে গেলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে ছিল একটি ছোট্ট মন্দির। যখনকার কথা বলছি তখন সেখানে আজকের মত এত লোক, দর্শনার্থীর সমাগম হতো না সব সময়, পূজা-পার্বণ ছাড়া। উপরে উঠে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে নাসির ভাই বলেন, ‘আজ টের পেলাম আমার শরীর ভারী হয়েছে’। যাই হোক, ঘরের এই সিঁড়ি বাইবার ভয়ে নিচে ড্রয়িং রুমেই আমার গোটা দিন কাটে, শোবার সময়টুকু ছাড়া। অতএব, হাতের ব্যথা যা ডাক্তারের ভাষায় ‘মাউস আর্ম’ তার যাবার সম্ভাবনা আপাতত কম, যেমন সম্ভাবনা কম শীঘ্র ‘করোনা’ বিদায় নেবার। করোনা শুরুর দিয়ে মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, সবাইকে ঘরে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারপর একটা সময় মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠলো। সমস্ত নিয়ম, বাধা-নিষেধ ভেঙে বেরিয়ে পরে ঘর থেকে। দেশে-বিদেশে সব জায়গায় একই চিত্র। হল্যান্ডসহ অনেক দেশে এই নিষেধ অমান্যকারীদের সাথে আইন প্রয়োগকারীর মুখোমুখি সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, লাঠিচার্জ, জল-কামান, গ্রেপ্তার ইত্যাদি নিত্য দৃশ্য। মানুষ মরছে, তারপরও মানুষ নিয়ম ভাঙছে।
এমন পরিস্থিতিতে বেড়েছে ‘ভার্চুয়াল মিটিং, সম্মেলন, আলোচনা। সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিন একটা না একটা এমনতর মিটিং লেগেই আছে। কাউকে ফোন করলে প্রায় সময় শোনা যায়, ভাই ভার্চুয়াল মিটিং-এ ছিলাম বা আছি। করোনা অনেককে কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে, অনেককে এতিম বানিয়েছে, অনেককে পথে বসিয়েছে। পাশাপাশি করোনা অনেককে ‘এক’ করেছে। সম্মিলন ঘটিয়েছে গোটা পরিবারকে কিংবা কোন গ্রুপকে। দাদা অর্থাৎ আমাদের ভাইদের সবার বড় যিনি, তিনি যখন করোনার শুরুতে মারা গেলেন, তখন তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আমাদের অনেকেই উপস্থিত হতে পারিনি, ভয়ে। আমাদের ছয় ভাইয়ের চার জনই দেশের বাইরে। দেশে যে একজন আছে (মেজদা) সেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে পারেনি। শুরুর দিকে এমনই আতংক ছিল গোটা দেশ জুড়ে। মাস খানেক বাদে দাদার মৃত্যু উপলক্ষে আয়োজন করা হলো ‘ভার্চুয়াল’ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বৌদ্ধ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে। তাতে যোগ দিল ভাইঝি, দাদার একমাত্র মেয়ে, প্যারিস থেকে লাকী, আমরা চার ভাই বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং আমি হল্যান্ড থেকে। দেশের দু’বোনও । অন্যান্য আত্মীয়রাও কেউ ঢাকা থেকে, কেউ চট্টগ্রাম থেকে। যে বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মীয় দেশনা করলেন, তিনি এক পর্যায়ে যে কথাটি বললেন তা মনে খুব ধরেছিল এবং সে কথাটি আজও মাঝে মধ্যে মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের প্রিয় ভাই, মরণের মধ্যে দিয়ে আপনাদের সবাইকে এক করে দিয়ে গেলেন। আজ কী সুন্দর গোটা পরিবারের সবাই আপনারা এক হয়েছেন’। কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু এটিও সত্যি এমন কঠিন ‘সুন্দর’ আমি চাইনি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্ররাজনীতি ও কিছু স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধইফতার সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম