হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৬ মার্চ, ২০২১ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নশীল দেশ : সাবাশ বাংলাদেশ
‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে আজকের বাংলাদেশ। কিসিঞ্জার তুমি কোথায়? জানতে ইচ্ছে করে কোথায় তার প্রেসিডেন্ট নিঙন। একাত্তর! সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, যুদ্ধে বিপর্যস্ত গোটা দেশ, ভঙ্গুর অর্থনীতি, ভঙ্গুর দেশের অবকাঠামো, স্বাধীন রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান সহ নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশকে শুরু থেকে রুখে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় হেনরী কিসিঞ্জার একাত্তরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্যে যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয় তার বিপক্ষে ‘ভিটো’ প্রদান করেন। সে সময় কিসিঞ্জারের তালিকায় সব চাইতে ঘৃণিত তিন নেতার যে তালিকা ছিল তার মধ্যে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় বাংলাদেশ স্বাধীনতা-আন্দোলন বিরোধী এই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জার অবজ্ঞাভরে বাংলাদেশকে তুলনা করেছিলেন ‘বটমলেস বাস্কেট’ অর্থাৎ ‘তলাবিহীনই ঝুড়ির’ সাথে। কিসিঞ্জারের এই অপমানজনক মন্তব্যকে এদেশের অনেককেই পরবর্তীতে তাদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার লক্ষ্যে সময়ে সময়ে ব্যবহার করতে দেখা যায়। তাদের মুখে চুনকালি পড়েছে কেননা বাংলাদেশ শনৈ শনৈ করে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে, উগ্র সন্ত্রাস, মুক্তিযুদ্ধ-আদর্শ-বিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সহ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবেলা করে। অন্যদিকে কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট নিঙন ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। মাথা উঁচু করে এগিয়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই অগ্রযাত্রা থেমে না গেলে আশা করা যাচ্ছে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্যে বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি। বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও লাওসের নামও সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যদিকে যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও মিয়ানমার এবং তিমুর লেসেথো এখনো সুপারিশ পায়নি বলে প্রকাশ। এই সুখকর ঘোষণা দিয়েছেন খোদ বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার পেছনে তার কৃতিত্ব, তার অবদান অনেকটা হলেও তিনি এই সুফলকে সাধারণ জনগণের অবদান বলে উল্লেখ করেন। এইখানে বলতেই হয় শেখ হাসিনার ঔদার্য্যের কথা। তিনি বলেন, “এই অর্জন সাধারণ জনগণের কঠিন পরিশ্রমের ফসল। আমরা এই ‘মাইলফলক’ অর্জন করেছি আমাদের যৌথ প্রয়াসের ফলে। এই বিশেষ মুহূর্তে আমি আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই দেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশের সকল নাগরিককে”। কথাটা খুবই সত্যি। বাংলাদেশ খাদ্যে অনেক আগেই স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে। সে অর্জন সম্ভব হয়েছে দেশের খেটে-খাওয়া চাষিদের পরিশ্রমের কারণে। বাংলাদেশ তার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ভারী করেছে, সেও খেটে-খাওয়া পরিশ্রমী গার্মেন্টস কর্মী ও প্রবাসী শ্রমিকদের কারণে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। এই অর্জন ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি পদক্ষেপ, যাতে আমরা ২০৩১ সাল নাগাদ ‘উচ্চ আয়ের দেশে’ পৌঁছাতে পারি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হতে পারি’। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত লক্ষ্য অর্জনে বর্তমান উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে হবে, আর সে ধারা বজায় রাখতে হলে গণতন্ত্রকে তার নিজস্ব পথে চলতে দিতে হবে, জনগণের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যা কিনা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম শর্ত।
কোন দেশ তার এলডিসি অবস্থান থেকে উত্তরণে যে সূচকগুলি আমলে আনা হয় তা হলো, সে দেশের মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এই ক্ষেত্রে কম করে হলেও দুটি সূচকের লক্ষ্যে পৌঁছানো কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয় এবং পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান আফ্রিকীয় দেশ উগাণ্ডা, কিরিবাতি, হাইতি, টুভালু, জিবুতি, গিনি, নেপাল, মিয়ানমারের মত দেশের কাতারে। স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের অবস্থান হবে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের কাতারে। ভাবতেই ভালো লাগে। কোথায় কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আর কোথায় আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের যে অর্জন সে তো কেবল একটি ক্ষেত্রে নয়। নানামুখী উন্নয়ন হয়েছে বিগত বছরগুলিতে। দেশের জিডিপি বেড়েছে, মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে, ইতিমধ্যে অর্জন করেছে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যের বা এসডিজি-র কতিপয় টার্গেট, দারিদ্র্য হার কমেছে, গড় আয় বেড়েছে, আইটি সেক্টরে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ গেছে এগিয়ে, ঈর্ষণীয়ভাবে। পাকিস্তানের কথা আমলেই নিলাম না। সেটি একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের চাইতেও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে আমরা দেখেছি সে দেশের কাউকে কাউকে এই বলতে, ‘আমাদের (পাকিস্তান) বৃটেন বা জার্মানি হবার দরকার নেই, আমাদের এখন প্রয়োজন বাংলাদেশের মত হওয়া’। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান কোথায়, আর ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ কোথায়।
তবে আমাদের এখনই হাততালি দিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সামনে ‘বন্ধুর’ পথ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক বলেছেন, আমাদের এই উন্নয়ন ধরে রাখতে হবে। আর সে জন্যে আরো কাজ করতে হবে। সামনে আরো চ্যালেঞ্জ। এই কারণে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করার ফলে বাইরে দেশের মর্যাদা বাড়লেও বাংলাদেশকে হারাতে হবে কিছু সুযোগ-সুবিধা যা এতদিন ভোগ করে আসছিল। রপ্তানি ক্ষেত্রে বিশেষ করে গার্মেন্টস, ওষুধ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। রপ্তানি ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে ভিয়েতনাম, নেপাল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানের সাথে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে যে সুবিধাদি এতদিন বাংলাদেশ ভোগ করছিল তা চলে যাবে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি এর আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও তিন বছর বহাল থাকবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই উত্তরণের ফলে বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বেশি সুদে হলেও ঋণ নিয়ে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক খরচ করা সম্ভব হবে, আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলির দেয়া ‘রেটিং’ বাড়বে, যা কিনা দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। এই প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের বিশেষ ভাবে দরকার ব্যক্তি খাতের রপ্তানিমুখী শিল্পে বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার মতো পরিবেশ তৈরি করা। এ ধরনের বিনিয়োগে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ফলে রপ্তানি বহুমুখী করা যেমন সম্ভব হয়, তেমনি রপ্তানি বাড়ার ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করে না। ভিয়েতনামের বড় সাফল্য এখানেই’। আগেই বলেছি, সামনে ‘বন্ধুর’ পথ। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সম্মানজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে। আর দেশের আপামর জনগণের কঠিন পরিশ্রমের ফসল, সেই ‘সম্মান’ ধরে রাখার জন্যে দলমত নির্বিশেষে দেশের, জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আমাদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ যাবে আরো এগিয়ে। তাকে ঠেকায় কার সাধ্যি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ
পরবর্তী নিবন্ধনিউইয়র্ক ফেড থেকে মিয়ানমারের জান্তার টাকা সরানোর চেষ্টা আটকাল যুক্তরাষ্ট্র