হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

দেশে ফিরে যাব, যাব না- কেন?
কথায় আছে ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস’। মানুষ চায় এক, উপরওয়ালা করে ভিন্ন। আমরা কত প্ল্যানই না করি, কত স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন তৈরি করি। কোন কোন স্বপ্ন বাস্তবের মুখ দেখে, বেশির ভাগ অকালে, অসময়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। কখনো করতে হয় সমঝোতা। বাস্তবের নিরিখে। বুঝি এটিই জীবন, জীবন প্রবাহ। এই যে চক্র এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না আমরা, বোধকরি সম্ভবও নয়। কথাগুলো বলার কারণ এই হল্যান্ড আসার এক বছরের মাথায় দেশে যেতে হয়েছিল দায়িত্ব নিয়ে। সেটি ছিল ১৯৯১ সাল। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময় ব্র্যাক ও প্রশিকা সহ দেশের ৮টি এনজিও-র রিলিফ ও পুনর্বাসন কাজ তদারক করার জন্যে যেতে হয়েছিল। এক সকালে রিকশায় চেরাগী পাহাড়ের মোড় হয়ে দৈনিক আজাদী অফিস যাচ্ছিলাম। উল্টোদিক থেকে আর একটি রিকশায় আসছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক অরুণ দাশগুপ্ত। সাথে আর এক ভদ্রলোক। আমাকে দেখে জানতে চাইলেন, কবে দেশে এসেছি। বললাম, ‘দিন কয়েক আগে, তবে একেবারে চলে আসবো’। শুনে তিনি সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘ওই কাজটি ভুলেও করবেন না’। আমি হেসেছিলাম। কেননা হল্যান্ডের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম বড় জোর বছর পাঁচেক, তারপর ফিরে যাবো দেশে। আজ পাঁচ বছর নয়, ৫ গুণ ৬ = মোট ৩০ বছর পার করে দিয়েছি, ফেরা আমার আর হয়নি। কবে হবে মনে হয় সেটিও জানা নেই। বছর দুয়েক আগেও জোর গলায় বলতাম, ফিরে যাবই। বড়ুয়াদার মত ফিরে যাওয়া নয়, কোনভাবেই নয়। হল্যান্ডে সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন, যার বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধু ভাগ্নী রাষ্ট্রদূত শেলী জামান সহ অনেক রথী-মহারথী, তাদের সবার বড়ুয়া দা চেয়েছিলেন শেষ বয়সে দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে শেষ বয়সে দেশে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। দেশে গেলে এখানকার উন্নত চিকিৎসা পাবেন না। ফলে আরো কিছুদিন বেঁচেছেন। এক সময় দেশে তিনি গেলেন, তবে অনেক প্রবাসীর মত লাশ হয়ে। আমি সেটি চাইনে। চাইনে বলে এতদিন বড় গলায়, জোর গলায় বলে এসেছি। কিন্তু সে-বলায় ইদানীং লক্ষ্য করি তেমন জোর পাইনে। বয়স যত বাড়ছে, ফিরে যাবার আকুতি বন্যার জলের মত তীব্র হলেও, বাস্তব আমাকে বলছে, যেও না, যেও না। অমন কাজটি ভুলেও করো না, আরো কিছুদিন নির্ভয়ে বাঁচো। অরুণদার সেই সাবধানী বাণী মনে পড়ে।
এখন বয়স যত বাড়ছে, হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ বাড়ছে। যোগাযোগ বাড়ছে চিকিৎসকদের সাথে। ভয়টা সেখানেই। এদেশে যে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় গত ৩০ বছরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তাতো দেশে গিয়ে কোনভাবেই পাব না, শত মাথা কুটেও। দেশে আপনার অঢেল অর্থ থাকলেই চলবে না, যেটুকু চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে তা পাবার জন্যে আপনার থাকতে হবে ‘কন্টাক্ট’, থাকতে হবে ‘মানুষ’। তা না হলে আপনাকে এ-দুয়ার ও-দুয়ার ঘুরতে হবে, ঘুরতে হবে এক ডিপার্টমেন্ট থেকে ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। টাকার শ্রাদ্ধ সে কথা বাদই দিলাম। এদেশের কিংবা ইউরোপের সাথে তুলনা করছিনে, করা যুক্তিসঙ্গতও নয়। কিন্তু যেটি দেশেও সহজে সম্ভব হতে পারতো, সেটিও প্রায় ক্ষেত্রে জুটে না রোগী কিংবা রোগীর নিকটজনের। এদেশে শারীরিক কোন সমস্যা দেখা দিলে ফোন করে আপনার সুবিধা মত আপনি নির্দিষ্ট দিন-সময় এপয়েন্টমেন্ট করে গেলেন তার চেম্বারে বা হাসপাতালে। অপেক্ষা করছেন ভিজিটরস রুমে। নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার এসে আপনার নাম ধরে ডেকে আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার চেম্বারে নিয়ে যাবেন। জানতে চাইবেন আপনার সমস্যা, আপনিও যা যা ইচ্ছে, প্রয়োজন জিজ্ঞেস করতে পারবেন। কোন তাড়া নেই, কোনদিক থেকে। যদি কোন এঙরে বা টেস্টের প্রয়োজন হয়, তিনিই সব ঠিক করে দেবেন আপনার সুবিধা মত দিন-সময় অনুযায়ী। ওষুধ- না, আপনাকে ফার্মেসী গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে তা অন-লাইনে পাঠিয়ে দেবেন নির্দিষ্ট ফার্মেসিতে। ফার্মেসির কর্মচারী গাড়ি নিয়ে ওই দিন বা পরদিন আপনার বাসার ঠিকানায় তা পৌঁছে দেবেন। এক মাস তারও আগে ঠিক করে রাখা কোন এপয়েন্টমেন্ট আপনার মনে না রাখলেও চলবে। ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল থেকে আপনার মোবাইলে খুদে-বার্তা পাঠিয়ে স্মরণ করিয়ে দেবে আপনাকে। অন্যদিকে দেশে হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ডাক্তার খুব উল্কা গতিতে আপনার কথা শুনে, তার চাইতেও তাড়াতাড়ি এক ফর্দ ওষুধ এবং নানা টেস্টের তালিকা লিখে ধরিয়ে দেবেন। আপনার কী সমস্যা তা জানতে চাইলে উল্টো ধমক খেতে হবে ডাক্তারের কাছে। বাড়তি কিছু বলতে গেলে বলবেন, ‘ডাক্তার আপনি না আমি’ ইত্যাদি। এতো গেল সমস্যার একটি দিক। ধরে নিলাম কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে এবং আপনার সেখানে যাবার মত আর্থিক সামর্থও আছে। যদি ঢাকার কথাই ধরি, তাহলে বলতে হয় হাসপাতাল পৌঁছুতে পৌঁছুতে ট্রাফিক জ্যামে আটকে সাধের প্রাণভোমরাটা উড়ে যাবার দশা। এই সব দেখে শুনে দেশে শেষ বয়সে একেবারে ফিরে যাবার যে তীব্র আকাংখা তাতে ভাটা পড়ে। তার মানে এই নয় যে দেশের প্রতি আকর্ষণ হারাতে বসেছি। দেশ মায়ের মত। তার প্রতি টান সে যে দশাই হোক না কেন থেকে যাবেই। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে বড়ুয়া দার মত অনেক প্রবাসী থেকে যান এই পরদেশে এবং দেশে ফিরে যায় নিথর দেহ, কারো এই দেশ হয় শেষ ঠিকানা।
আমার ৮৩ বছরের শাশুড়ির গল্প বলে এই লেখা শেষ করবো। তার স্বামী, একটু আগেই উল্লেখ করেছি, বড়ুয়াদা, ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন। শাশুড়ি থাকেন একা, ড্রয়িং রুম সহ তিন কামরার একটি ছোট ফ্ল্যাটে। তিনি কারো গলগ্রহ হতে চাননা, তাই মেয়ে-ছেলেরা তাদের সাথে রাখতে চাইলেও তিনি একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। বিপদে বা ইমার্জেন্সিতে কোন প্রয়োজন হলে, তিনি যদি ফোন করার মত শারীরিক দশায় না থাকেন, সে কারণে, একটি বেল আছে, তা টিপ দিলেই হেলথ সেন্টারে বেজে উঠবে এবং তড়িৎ ডাক্তার, এম্বুলেন্স চলে আসবে। একই ব্যবস্থা তার টয়লেটেও। সেখানেও আছে বেল। সব ব্যবস্থা সরকার থেকে। সরকার থেকে রাখা হয়েছে তার জন্যে এক মহিলা, যিনি সপ্তাহে দুবার এসে তার ঘর-বিছানা, টয়লেট সব পরিষ্কার করেন। তার দায়িত্ব রান্না করাও। কিন্তু শাশুড়ি তা করতে দেন না, কেননা বিদেশি এই মহিলা বাংলাদেশি খাবার রান্না করতে পারবেন না, করলেও তা কতটুকু খাবার উপযোগী হবে তা বলা বাহুল্য। কৌতূহলবশতঃ আমি তাকে বার কয়েক বলে দেখেছি, দেশে ফিরে যাবার জন্যে। তিনি কিছুতেই রাজী নন। অথচ আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে তিনি তার গ্রামের বাড়ি, গোয়ালের গরু, পুকুরের মাছ, পাড়ার নিকটজন ছেড়ে ইউরোপের এই অতি উন্নত দেশটিতে এসে স্বামীর সাথে যোগ দেবেন না। তাকে সে সময় অনেকটা জোর করে আনা হয়েছে। সেই তিনি এখন দেশে ফিরে যেতে চান না। তার ভয়, দেশে গিয়ে যদি শরীর খারাপের দিকে যায় তাহলে তিনি কি এখানকার সেবা পাবেন?
ইউরোপীয়দের কাছে ছুটি মানে পাহাড় কিংবা সমুদ্রের দিকে ছুটে যাওয়া। আমাদের কাছে ছুটি মানে দেশ, শত অব্যবস্থা ও অনিয়মের মাঝেও। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে শরীর যত বেঁকে বসছে দেশে ফিরে যাবার যে তীব্র আগ্রহ এতদিন লালন করেছি, অস্বীকার করেনি তাতে একটু ‘ঢিলেমি’ পড়েছে। এখন আর আগের মত জোর গলায় বলতে পারিনে, ‘ফিরে যাবোই’। হয়তো মনের ভেতর এই ভয়টা বাসা বেঁধেছে যে কিছু হলে কোথায় যাবো? কোথায় পাব এখানকার নিশ্চিত চিকিৎসা ব্যবস্থা? পারবো কি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে? কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। কি বললেন, দেশে কি এত লোক নেই? আমার সমস্ত নিকটজন, আত্মীয়, বন্ধু সবাই তো দেশে। কিন্তু ওই যে মানুষ অভ্যাসের দাস। তার উপর ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস। মানুষ চায় এক, উপরওয়ালা করে ভিন্ন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিতা-পুত্রীর এক সোনাঝরা বিকেল : ‘পেছনে তাকালে বুক হু হু করে ওঠে’
পরবর্তী নিবন্ধভ্যাকসিন সাফল্যে নতুন দিগন্ত