হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

ট্রাম্পোত্তর ‘দি ডিভাইডেড
স্টেটস অব আমেরিকা’
ফিজিক্সের ছাত্র আমি নই। ফিজিক্স সহজ না কঠিন জানা নেই। তবে এলবার্ট আইনস্টাইনের কথায় বুঝতে পারি, ফিজিক্স কঠিন বিষয়। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার, তার কাছে রাজনীতি ফিজিক্সের চাইতেও কঠিন। তিনি বলেছেন, ‘পলিটিক্স ইজ মোর ডিফিকাল্ট দ্যান ফিজিক্স’। ফিজিক্স বুঝি না, রাজনীতির মারপ্যাঁচও না। তবে অভিজ্ঞতায় বলে, রাজনীতিতে কোনটি সঠিক তা নির্ভর করে আপনার অবস্থানের উপর কিংবা সময়ের উপর। রাজনীতিতে ‘ক’ দলের কাছে যা সঠিক, দিন বদলের সাথে সাথেই ‘খ’ দল তাকে মিথ্যে প্রমাণিত করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। দলের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশ ও গণতন্ত্রের জন্যে যা সঠিক, তা খুব সংখ্যক রাজনীতিবিদ খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন। বোধকরি তাই জন এফ কেনেডি বলেছিলেন, ‘আসুন, আমরা রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাটিক-উত্তর না খুঁজে, সঠিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি’। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোন কথা নেই- সে আমরা জানি। জানি বলেই দেখি রাজনৈতিক নেতাদের ডিগবাজি দিতে। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে। রাজনীতিতে লজ্জা-শরম থাকতে নেই। ধারণা ছিল দেশভেদে এর রূপ ভিন্ন হয়। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যে সমস্ত ঘটনাবলী ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে, সেখানকার রাজনৈতিক নেতাদের যে কার্যকলাপ, তাতে আমেরিকা আর অনুন্নত দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের মাঝে তেমন একটা ফারাক দেখি না। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ জন রিপাবলিকান সিনেটর কী করে, কোন বিবেকে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর বিরুদ্ধে সিনেটে ভোট দিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কখনো যা হয়নি তাই করলেন ট্রাম্প দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে। বেআইনিভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার জন্যে নির্বাচনে হেরে গিয়েও তিনি তা মেনে নিলেন না। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের আদালত, এমন কী সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত গেলেন, প্রতিটি আদালত তার দাবি ভিত্তিহীন বলে বাতিল করলো। তিনি একটির পর একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোটের ফলাফল তার পক্ষে নেয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেন। কিছুতেই কিছু না হলে তিনি উসকে দিলেন তার অন্ধ-অনুসারীদের। উত্তেজক বক্তব্য দিয়ে তিনি তাদের ‘ক্যাপিটাল হিল’ আক্রমণ করার জন্যে বললেন। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। তার ফলাফল কী সে তো সবার জানা। এমন দৃশ্য উন্নত বিশ্বে তো নয়ই, অনুন্নত বিশ্বেও দেখা যায় না। ট্রাম্পের দাঙ্গা বাহিনীর এই সন্ত্রাসী অভিযানে পাঁচজন মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিকা সহ গোটা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়। ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় তো বটেই এমন কী তার দলের অর্থাৎ রিপাবলিকান দলের নেতাদের কেউ কেউ বলেন, ‘এমন ঘটনা ভেনেজুয়েলার মত দেশে সম্ভব, আমেরিকায় নয়’। তারা ট্রাম্পের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। কেউ কেউ এর বিচারও দাবি করেন। রিপাবলিকান দলীয় সিনেট মেজরিটি নেতা মিচ্‌ ম্যাককোনেল এই ঘটনার জন্যে ট্রাম্পকে দায়ী করে বলেন, তিনি (ট্রাম্প) জনগণকে মিথ্যে বলে এসেছেন এবং এ তারই ফসল। তাকে এর পরিনাম ভোগ করতে হবে’। কিন্তু ট্রাম্পকে ‘ইমপিচ’ করার প্রস্তাব যখন সিনেটে উঠলো তখন অনেককে অবাক করে মিচ্‌ ম্যাককোনেল সত্যের পক্ষে না গিয়ে ট্রাম্পের পক্ষ নিলেন এবং বিচারের বিপক্ষে ভোট দিলেন। একে কী বলে আখ্যায়িত করবো? রাজনৈতিক ডিগবাজি? নাকি নীতি-বিবর্জিত, মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিবিদ?
ট্রাম্প গেছেন। বিগত চার বছর আমেরিকার ক্ষমতায় ‘জগদ্দল পাথরের’ মত বসে থেকে এই ‘অরাজনৈতিক’ ব্যক্তিটি রাজনীতির সংজ্ঞাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়ে গেছেন। ‘দি ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকাকে’ তিনি ‘দি ডিভাইডেড স্টেটস অফ আমেরিকা’ বানিয়ে গেছেন। জনগণের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে গেছেন, যা রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে আর শোধরাবার নয়। ট্রাম্প গেছেন বটে তবে চিরদিনের তরে যে নয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর সে কথা তো তিনি তার শেষ বিদায় ভাষণে বলে গেছেন। তার সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আবার দেখা হবে, অন্য কোনভাবে’। তার ফিরে আসাটা কিংবা রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার। ট্রাম্প মার্কিন রাজনীতি থেকে আপাতঃ দৃষ্টিতে ‘ইনভিজিবল’ মনে হলেও তিনি কিন্তু পুরোদমে আছেন। তার যে প্রভাব, বলয় তার থেকে রিপাবলিকান দলীয় নেতারা কিংবা দল বেরিয়ে আসতে পারছে না এখনো, পারবে সে লক্ষণও দেখা যায়না। ক্ষমতায় না থেকেও তিনি দূর থেকে, দলের সুতো টানছেন। রিপাবলিকান দলীয় নেতাদের সবাই যে তাকে পছন্দ করেন তেমন না। কিন্তু তার (ট্রাম্প) রাজনৈতিক প্রভাব গোটা দেশে এখনো এমন প্রকট যে কোন রিপাবলিকান দলীয় নেতা প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করতে সাহস পান না। তারা খুব ভালো করেই জানেন, ট্রাম্পের রয়েছে একটি বিশাল ভোট ব্যাংক। গেল নির্বাচনে তিনি প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোট পেয়েছেন, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। তাকে বিগড়ে কোন নেতা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন সে সৎ সাহস রিপাবলিকান দলের মধ্যে হাতে গোনা। আর হাতে গোনা বলেই ৫০ দলীয় রিপাবলিকান সিনেটরের মধ্যে কেবল ৫ জন সাহস করে তার বিরুদ্ধে ভোট দিলেন গেল সপ্তাহে, তার বিচার চেয়ে। এদের মধ্যে রয়েছেন, উটাহ থেকে মিট রমনি, নেব্রাসকা থেকে বেন সাসে, মাইন্‌ থেকে সুজান কলিন্স, আলাস্কা থেকে লিসা মুরকোভস্কি এবং পেনসিলভেনিয়া থেকে প্যাট টুমি। আশা করেছিলাম রিপাবলিকান দলীয় সিনেট মেজরিটি নেতা মিচ্‌ ম্যাককোনেলও এই দলে যোগ দেবেন। দেননি। বাকি যারা ট্রাম্পের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তাদের সবাই যে ‘প্রেসিডেন্ট পদে এখন ট্রাম্প আর নেই বলে তার বিচার করা যাবে না’ এই যুক্তিতে বা নিয়মে বিশ্বাস করেন তা ভাবার কোন কারণ নেই। তাদের ভয় বিপক্ষে গেলে তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ট্রাম্প তার অনুসারীদের তাদের পক্ষে ভোট না দেবার জন্যে উৎসাহিত করতে পারেন। ট্রাম্প অপরাধ করেছেন সন্দেহ নেই। সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পথে গিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন। সমস্ত সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা শেষতক হয়তো সম্ভব হবে না। কেননা তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে রিপাবলিকান দলের ১৭ জন সিনেটরের সমর্থন দরকার। সে প্রয়োজনীয় সমর্থন যে তারা পাবেন না সে খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন। তবে তিনি বলেছেন, ‘যে ঘটনা ঘটে গেছে ক্যাপিটল হিলে, তার বিচার হওয়া খুব দরকার’। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই বিচার তিনি উৎরে যাবেন। আর উৎরে যাওয়া মানে ২০২৪ সালে তার (ট্রাম্প) পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়া। এবারের নির্বাচনে প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোট পেয়ে তার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, যা প্রথমবার ছিল না। কেননা তখন তিনি নিজেও অবাক হয়েছিলেন জয়ী হয়ে। তিনি নিজেও আশা করেননি যে তিনি সত্যি সত্যি আমেরিকার মত একটি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এবং জনগণের ভোটে। অবাক আমরা কম হইনি। অবাক হয়েছে গোটা বিশ্ব।
এবং ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসা মানে পুনরায় পট পরিবর্তন- সে বলা বাহুল্য। জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে প্রথম সপ্তাহেই প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে ট্রাম্পের অনেক অগণতাত্রিক ও অমানবিক পদক্ষেপ বাতিল করেছেন। বাইডেন করেছেন গণতন্ত্রের কল্যাণের জন্য, সাধারণ জনগণ ও বিশ্বের মঙ্গলের জন্য। ট্রাম্প যদি পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্টিত হন তাহলে তিনিও তার কলমের খোঁচায় যে বাইডেনের নেয়া সমস্ত পদক্ষেপ বাতিল করবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। করবেন এই কারণে- ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। তিনি পুনরায় বর্ডার বন্ধ করবেন কিছু মুসলিম দেশের জন্য, মেক্সিকোর সীমানা প্রাচীর নির্মাণ যা বাইডেন স্থগিত করেছেন পুনরায় নির্মাণ শুরু করবেন এবং বিদেশি ঠেকাও অভিযান শুরু করবেন নতুন উদ্যোমে। বৈষম্যমূলক যে সমস্ত কার্যকলাপ ছিল ট্রাম্পের আমলে যা জো বাইডেন বন্ধ করেছেন তা তিনি পুনরায় শুরু করবেন, কেননা তার দৃষ্টিতে তার-নেয়া পদক্ষেপ ছিল আমেরিকার জন্যে মঙ্গল। এই প্রসঙ্গে জন এফ কেনেডীর কথাটাই মনে পড়ে যা শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আসুন, আমরা রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাটিক-উত্তর না খুঁজে, সঠিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি’। বাস্তব হলো, আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকেই তা খোঁজার চেষ্টা করেন না। সে বাংলাদেশ হোক আর আমেরিকা। কোন তফাৎ দেখিনা কোথাও।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামলেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও সংক্ষিপ্ত ইতিকথা
পরবর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনা : সামাজিক নিরাপত্তায় দীপ্র কিংবদন্তী