হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:২৫ অপরাহ্ণ

সূর্য-উঠা ভোরের সাথে আমার খুব কম সাক্ষাৎ হয়েছে এই জীবনে। এই জীবনে অনেক কাজই তো করতে পারিনি, তার মধ্যে এই ভোরে উঠতে পারাটা অন্যতম। বাবার বকুনি খেয়েছি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছি তখনও। প্রায় প্রতিদিন। ‘ও (অর্থাৎ আমি) কোনদিন মানুষ হবে না’, বাবার এই শব্দগুলি শুনে আমার প্রায় প্রতিদিনকার সকাল শুরু হতো। সারা রাত ধরে কাজ করতে পারি, কিন্তু ভোরে উঠা, সে ছিল হিমালয় পাহাড়ে উঠার চাইতেও কষ্টকর ব্যাপার, অন্ততঃ আমার কাছে। মা-বাবা ছাড়া আমাদের বাসার প্রায় সবাই এই দলে, তবে আমি শীর্ষে। মনে পড়ে বান্দরবান থেকে দিদির জামাই বাসায় এসে পৌঁছেও দেখতে পেতেন দু-একটি খাটের উপর তখনও মশারি টাঙানো। মনে মনে তিনি বিরক্ত হয়তো হতেন, যদিও বা মুখে কিছু বলতেন না। তিনি আমাদের বাসার নাম দিয়েছিলেন ‘নিদ্রালয়’। যাই হোক, বুদ্ধগয়া রাত তিনটায় পৌঁছে রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে খুব একটা ঘুম হলো না। পৌনে ছ’টা নাগাদ ভাগ্নি জামাই মানিক এসে দরোজায় টোকা দিল। অগত্যা বিছানা ছাড়তেই হলো। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এতটা পথ মাড়িয়ে, এতো ঝামেলা সয়ে এই পুণ্যভূমিতে আসা, সে কি ঘুমের কারণে বিফলে যাবে। মনে মনে বলি, ওঠ বিকাশ, আর আলস্য নয়। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে বাইরে এসে যে দৃশ্য দেখলাম মুগ্ধ হলাম। বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে মাঠে সাদা পোশাক পরনে একদল পুরুষ-মহিলা, খুব সম্ভবতঃ থাই, তিব্বতীয় কিংবা কোরিয়ান, প্রায় সবার হাতে পূজার সামগ্রী, সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, বুদ্ধের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত মহাবোধি বুদ্ধ মন্দিরের দিকে রওনা দেবার জন্যে। এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে আমার সমস্ত আলস্য মুহূর্তে উধাও। বাংলাদেশ মন্দির থেকে কাছেই সেই পুণ্যস্থান, যেখানে মহামতি বুদ্ধ অর্জন করেছিলেন বুদ্ধত্ব। গেইটের বাইরে এসে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা ভোলার নয়। শ’য়ে শ’য়ে নর-নারী নানা রঙের, নানা আকারের, নানা ভাষা-ভাষী মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে চলেছেন ধীর পায়ে মহাবোধি বুদ্ধ মন্দিরের দিকে। বুঝতে পারি বিভিন্ন দেশ থেকে, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এদের আসা। তাদের অনেকের সামনে ব্যানার ধরা। একটু একটু শীত, প্রায় সবার গায়ে শীতের কাপড়। কারো মাথায়, গলায় মাফলার। ধর্মের এমন রূপ আগে দেখিনি, এমন একাগ্রতা চোখে পড়েনি।
বুদ্ধগয়া মন্দির এলাকার প্রবেশ মুখে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বালির বস্তা স্তূপাকারে রাখা, তার পেছনে অস্ত্র নিয়ে প্যারা-মিলিটারি, পুলিশ। মোবাইল ফোন নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না, নেয়া যাবে না কোন ব্যাগ। সেগুলি জমা দেবার ব্যবস্থা আছে প্রবেশ মুখের একটু আগে, ডান দিকে, কয়েকটি কাউন্টারে। সেখানে জমা দিলেই আপনাকে একটা টোকেন ধরিয়ে দেবে, তার জন্যে কোন টাকার প্রয়োজন হবে না। তবে ক্যামেরা নেয়া যাবে। এক সময় এখানে কোন নিরাপত্তা-ব্যবস্থা ছিল না। এখন সময় বদলেছে। এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজের বিশ্বাসকে জোর করে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। তারা নির্দ্বিধায় নিরীহ মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করে না। যে পবিত্র স্থান থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে বুদ্ধত্ব অর্জন করেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ শান্তির বাণী ছড়িয়েছিলেন, সেই স্থানটিও রেহাই পায়নি এই ঘৃণ্য ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের থাবা থেকে। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ভোর সোয়া পাঁচটায় ২৫০০ হাজার বছর পুরানো মহাবোধি মন্দির চত্বর এই সন্ত্রাসীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ওই দিন পর পর নয়টি বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল গোটা মহাবোধি বুদ্ধ মন্দির এলাকা। এই সন্ত্রাসী আক্রমণে কেউ নিহত হননি, কেবল এক তিব্বতীয় ও এক বর্মীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু আহত হয়েছিলেন। অনেকে বলেন, ধর্মের গুণ। এই সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটিয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’ নামে এক সন্ত্রাসী ইসলামী দল। মন্দিরের ভেতর ৮ ফুট উঁচু যে বুদ্ধমূর্তি তার নিচে দু’টি বোমা এবং কাছেই কর্মপা মন্দিরের কাছে একটি বোমা পুলিশ নষ্ট করে ফেলেছিল। ধরা পড়ে সন্ত্রাসীরা। এদের মূল পাঁচজনকে পাটনা আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারত সরকারের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদীনকে’ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সন্ত্রাসী দলটি ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের এই সমস্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা নিয়ে এই কড়া নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাই সামনের দিকে।
দলে দলে সবাই এগিয়ে চলেছে। কারো কোন তাড়া নেই। সবার মত আমারও লক্ষ্য সেই স্থানটি, সেই অশ্বত্থ বৃক্ষ, যার নিচে বসে ধ্যান করেছিলেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। রাজ্য, রাজভোগ, স্ত্রী, পুত্র রাহুল সব কিছু ছেড়ে এসেছিলেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। এক পর্যায়ে দূর থেকে দেখতে পাই মহাবোধি বৌদ্ধ মন্দির, অশ্বত্থ বৃক্ষ। বিস্ময় লাগে। অবাক আমি তাকিয়ে রই। কাছে গিয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানাতেই আমার শিরে শিরে যেন বুদ্ধের প্রসাদের ধারা বয়ে যায়। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না আমার সেই মুহূর্তের অনুভূতি, মনের অবস্থা। সে এক অজানা ভালোলাগা। আর দশজন যেভাবে ধর্ম করে আমি সে দলে নই। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘টেম্পল-গোয়িং পার্সন’ আমি সে দলে নই। তবে প্রতিদিন আমার দিন শুরু হয় বুদ্ধকে স্মরণ করে। মানুষকে ভালোবাসার মাঝেই, কর্মের মাঝেই আমার ধর্ম বলে আমার বিশ্বাস। পাশাপাশি ভিন্ন কোন ধর্মের প্রতি আমার অশ্রদ্ধা নেই, কারো থাকা উচিতও নয় বলে মনে করি। যাই হোক- যে দিকে তাকাই চোখে পড়ে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে কেউ কেউ অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে চলেছেন, কেউ কেউ মন্ত্র উচ্চারণ করে এগিয়ে। কেউ কেউ গাছকে ঘিরে মাটিতে বসে ধ্যানমগ্ন। পরিষ্কার পরিছন্ন গোটা এলাকা। অনেক তিব্বতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহীকে দেখলাম প্রবেশ মুখ থেকে পায়ে না হেঁটে মাটির উপর লম্বা হয়ে শুয়ে প্রণাম করতে করতে এগিয়ে চলেছেন মহাবোধি মন্দিরের দিকে। নানা বর্ণ, নানা আকৃতি, নানা ভাষাভাষীর এরা। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেন না। এক একজন এক একভাবে তার শ্রদ্ধা, ভক্তি জানিয়ে চলেছেন। চারদিকের গোটা পরিবেশ প্রশান্ত, ধর্মীয় ভাবগম্ভীর ও পুত পবিত্র। মনে হলো, এই পুণ্যস্থানটিতে আসতে না পারলে আমার জীবনটাই বৃথা থেকে যেত। বুদ্ধগয়া ভ্রমণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়েছিলেন। সেই কথা তিনি জানান দিয়েছিলেন মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখা এক চিঠিতে। তাতে কবি লিখেছেন, “বুদ্ধগয়াতে থাকবার সময় যদিও অনেক অনিয়ম সহ্য করতে হয়েছিল তবু সেখানকার বৌদ্ধমন্দির দেখে এ কথা মনে হয়েছে যে না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ থাকত”। আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম কবিগুরু বুদ্ধগয়া এসেছিলেন তার দলবল নিয়ে। ছিলেন ক’টা দিন। সাথে ছিলেন সন্তান রথীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ পরে লিখেছেন, “এই বুদ্ধগয়া-সন্দর্শনের ফলে উত্তরকালে বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্যে পিতৃদেবের অন্তরের আকর্ষণ প্রগাঢ় গভীর হয়ে উঠেছিল। শান্তিনিকেতন ফিরে এসে আমাকে তিনি ‘ধম্মপদ’ আগাগোড়া মুখস্থ করতে দিয়েছিলেন। পালি পড়াও শুরু হল এবং পিতারই আদেশক্রমে অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ তর্জমার দুঃসাহসে প্রবৃত্ত হলুম। রবীন্দ্রনাথের মত তিনিও বুদ্ধগয়ায় এসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বাবার উৎসাহে যে ‘বুদ্ধচরিত’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, সেটি ছিল তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বুদ্ধগয়া ভ্রমণ শেষে তিনি তার ডায়রীতে লেখেন, “বুদ্ধ, তুমি কি পুণ্যদিবসেই এই পুণ্যভূমির এক রাজপ্রাসাদে তোমার সেই উদার ভাবনা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে। কি সুদুঃসহ তপঃসাধন বলে বিশুদ্ধ ধর্ম্মজ্ঞান উপার্জন করিয়া প্রবুদ্ধ হইলে। বৌদ্ধযুগ ভারতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে একটি প্রধান যুগ। বৌদ্ধযুগই ভারতবর্ষের গৌরব। আশ্চর্য্য এই যুগের বিষয় কেহই অনুসন্ধান করে না। আমি আজ থেকে ব্রত নিলুম ভারতবর্ষের এই সময়ের লুপ্ত ইতিহাস পৃথিবীর কাছে উদঘাটিত করতে চেষ্টা করব। আমার এই চেষ্টায় যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকে”। জানিনে কবি-পুত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এই প্রচেষ্টায় কতটুকু সফল হয়েছিলেন। আমার জানা নেই। কারো আছে কি?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. রশীদ আল ফারুকী : বহুধাবিস্তৃত এক প্রতিভার নাম
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা