হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

অনেক বছর আমাকে দেশে আসতে দেয়া
হয়নি- খোলামেলা আলাপচারিতায়
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন – ২
অনেক কিছুই জানা ছিল না। জানা ছিল না যে বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবুল মোমেন এক সময় সরকারি রোষানলে পড়ে চাকরি হারিয়েছিলেন। কেবল তাই নয় তাকে নিজ দেশে ‘পার্সন নন গ্রেটা’ অর্থাৎ ‘অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করা হয়, যার ফলে বাংলাদেশে তিনি ছিলেন নিষিদ্ধ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দেশ-বিরোধী কাজে লিপ্ত। তাকে আসতে দেয়া হয়নি নিজ দেশে। তাতে তার চাইতে বড় ক্ষতি হয়েছে নানা কারণে হতভাগা এই দেশের। তার মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হয়েছে অনেকটা সময়। সবকিছু ঘটেছিল আশির দশকে, মিলিটারি সরকারের সময়। মনের ভিতর পুঞ্জীভূত এই সমস্ত কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রী কোন রাখঢাক না রেখে বলছিলেন সামপ্রতিক এক সন্ধ্যায়, ডিনার-টেবিলে, খেতে খেতে এবং খাবারের পর। সে ডিনার-সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল হল্যান্ডে ‘বাংলাদেশ হাউজে’। আয়োজক রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদউল্লাহ। তার বাঁয়ে বসা পররাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘আমার বাপ যখন মারা গেলেন তখন আমি দেশে আসতে পারিনি। তখন আমি তৎকালীন সরকারের দৃষ্টিতে দেশের শত্রু’। আমরা, ডজন খানেক বাংলাদেশী তার এই কষ্টের কথা শব্দহীন শুনছিলাম। ‘ভাবছিলাম দেশে ফিরবো না,’ বললেন তিনি। কতটুকু কষ্ট, দুঃখ, ক্ষোভ, অভিমান থাকলে এই ধরনের কথা বের হয় সে বলা বাহুল্য। ’৭৮ এর পর ১৯৯১ সালে প্রথম দেশে গেলাম।’ দেশের টান, সে আমরা যারা বিদেশের মাটিতে অনেক বছর, কেউ কেউ কয়েক যুগ ধরে আছি তারা উপলদ্ধি করেন অনুক্ষণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘২০১৫ সালে শেখ হাসিনা আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তবে আমার ফিরে-আসাটা অতটা সহজ ছিল না। আমাকে আমেরিকার নাগরিকত্ব ‘রিলিংকুইশ’ করতে হয়েছে।’ একটু হেসে বলেন, ‘মজার ব্যাপার হলো আমেরিকার নাগরিকত্ব সারেন্ডার করতে আমাকে টাকা দিতে হয়েছে। পরিবারের সবাই আমার এই সিদ্ধান্তে অসুন্তষ্ট। ছেলে-মেয়েরা বলে, ‘আব্বু, তুমি ‘সবচেয়ে বোকার মত’ (এখানে যে ইংরেজি শব্দ তিনি ব্যবহার করেছিলেন তা হলো, ‘ডামেস্ট ডিসিশন’) সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। লোক ইউ এস সিটিজেনশিপের জন্যে টাকা দেয় আর তুমি তা ‘বাদ’ দিতে টাকা দিচ্ছ। একবার এই নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে আর ফিরে পাবে না, তারা বলে। সব উপেক্ষা করে আমি চলে এলাম বাংলাদেশে।”
এই সমস্ত কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলছিলেন খাবার-পর্ব শেষে, রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদউল্লাহ তাকে এবং তার পত্নী সেলিনা মোমেনকে ধন্যবাদ জানানোর পর। ড. মোমেন হেসে বলেন, ‘এখন তো খেলাম, খেলে তো কিছু বলতেই হয়। তা আমি বসেই বলি’ বলে শুরু করলেন, “নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমাকে নিউ ইয়র্ক পাঠালেন, রাষ্ট্রদূত বানালেন। তিনি প্রথমে আমাকে সৌদি আরব পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলি, ‘আগে আমার বসকে (স্ত্রী) জিজ্ঞাসা করি। (হাসির রোল উঠে তখন উপস্থিত অতিথিদের মাঝে) সে রাজি হলে যাবো।’ উনি বলেন, ‘তাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার।’ নেত্রী আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগ দেয়ার জন্যে বললেন। তখন মার্চ মাস। তাকে জানালাম, ‘সম্ভব না এই সময় যাওয়া, কেননা ছেলে-মেয়েদের মিড্‌-টার্ম পরীক্ষা আছে, সেমিস্টারের শেষ পর্যায়, মে মাসের দিকে যাব’। তিনি দীপু মনির সাথে আলাপ করতে বললেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এক পর্যায়ে দেখা গেল আমার ফাইল খুঁজে পাওয়া যায়না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফাইল পাওয়া গেলেও এস বি ক্লিয়ারেন্স থেকে শুরু করে নানা আনুষ্ঠানিকতা। এক পর্যায়ে ফাইল পাওয়া গেল। কিন্তু সৌদি আরবে আদম ব্যাপারীদের অনেকেই আমার এই নিয়োগের বিরোধিতা শুরু করেন। কেননা আমি যখন সৌদি আরব ছিলাম তখন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে বেশ কিছু কাজ করেছিলাম।” ড. আবুল মোমেন সৌদি আরব থাকাকালীন সময় বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় জন্যে কাজ করেছিলেন, নিয়েছিলেন বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপও। নব্বই দশকের শুরুর দিকে তিনি মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে ‘দাসত্বের’ লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু পাচার প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখেন। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে উঠের ‘জকি’ শিশুদের বাংলাদেশ থেকে পাচার বন্ধেও তিনি বড় ভূমিকা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে শিশু ও নারী পাচার সম্পর্কে যে শুনানি হয় তাতে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। এই সমস্ত পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন তার নির্দিষ্ঠ কর্মপরিধির বাইরে গিয়ে।
সৌদি আরবে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় তিনি ‘শোর’ তোলেন বলে তিনি রাষ্ট্রদূত হিসাবে সেখানে যেতে পারেননি। এতেই প্রতীয়মান হয় এই মানব-পাচারকারীরা কী ক্ষমতাবান। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘নেত্রী বললেন, আপনাকে নিউ ইয়র্ক পাঠাবো। শুনে আমি বলি, ‘আমি তো ডিপ্লোমেট না, শিক্ষক, সেখানে বড় বড় ডিপ্লোমেটরা। এইভাবে সরকারি চাকরিতে আমার আসা। নিউ ইয়র্ক যাবার আগে নেত্রী আমাকে বললেন, পর পর ৫ বার আমরা দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসাবে প্রথম হয়েছি। আমাদের এই দুর্নাম ঘুচাতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশে একদিনে ৬৪টি জেলায় বোমাবাজি হয়েছে। আমাদের দেশের ইমেজ নষ্ট হয়েছে তাতে। আমাদের দেশ তো এমন ছিল না। আপনাকে এই সমস্ত দুর্নাম খণ্ডাতে হবে’। নেত্রী যখন এই সমস্ত কথা বলছিলেন এক পর্যায়ে তিনি ‘ইমোশোনাল’ হয়ে পড়েন, আমিও। উত্তরে আমি বলি, ‘আমি জানি না আমি কী করতে পারবো, কিন্তু আমি আমার সমস্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ তারপর তার স্বভাবসুলভ হাসি মেলে বলেন, ‘শেখ হাসিনা না হলে আমি কখনো মন্ত্রী হতে পারতাম না। মজার ব্যাপার হলো, মন্ত্রী তো হলাম, কিন্তু মন্ত্রণালয়ে এসে ‘আই ওয়াজ শক্‌ড’। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে আমার মিনিস্ট্রির বয়স, কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত কোন বই এতদিন প্রকাশ হয়নি। ব্যক্তি বিশেষ আর্টিকেল লিখেছেন, কিন্তু ‘নো বুক’। আমি এখনো পারিনি, মাতব্বরদের জ্বালায়। কেন জানি পাবলিকেশনের প্রতি দেশে এক ধরণের অনীহা।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রকাশনার এই বিষয়টাকে যেভাবে অনুধাবন করেছেন তার অন্যতম কারণ বোধকরি তার মূল পেশার কারণে। তিনি ছিলেন শিক্ষক। বোস্টন নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও এম বি এ-তে পি এইচ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শিক্ষকতা করেন মাসাচুয়েট্‌েসর ফ্রামিংহাম স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে কয়েকটি কলেজে অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয় পড়ান। গঠন করেন ‘বিজনেস লিডারশীপ ক্লাব’ এবং ‘এঙসেলেন্ট টিচার’ পুরস্কার লাভ করেন। কাজ করেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, সৌদি মিনিস্ট্রি অব ফাইনান্স এন্ড ন্যাশনাল ইকোনমির বিশেষজ্ঞ হিসাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ইংরেজি, বিশেষ করে ‘স্পোকেন ইংলিশ’ ভালো হওয়া দরকার। ডিপ্লোমেটদের বাংলা ইংরেজির পাশাপাশি আর একটি বিদেশি ভাষা জানা খুব দরকার। তাতে বিদেশে ভাব-বিনিময়, কাজ করতে সুবিধা, নিজেদের কনফিসেন্স বাড়ে। অন্ততঃ ফরাসী কিংবা আরবী। আবার আমার অনেক অফিসার বলেন, আরবি শিখলে তো শুধু মিডল ইস্টে পোস্টিং হবে। তিনি বলেন, আমার অনেক অফিসারের মধ্যে ‘কনফিডেন্স লেভেল’ কম, যদিওবা আমরা কারো চাইতে কম নই। কিন্তু আমাদের অনেকে নিজেকে ‘খাটো’ করে দেখেন। পিএইচডি-র সময় বলা হতো, সব সময় মনে রাখবে ‘ইউ নো দি বেষ্ট।, দিজ ইজ দ্য সাবজেক্ট ইউ হ্যাভ রিসার্চাড, স্টাডিট। এই মানসিকতা থাকতে হবে’। তারপর হেসে বলেন, ‘ভুল হলেও চালিয়ে যাও’। উপস্থিত প্রবাসী এঙপেটদের দেশে তাদের মেধা কাজে লাগানোর প্রয়োজনের কথা বললে উপস্থিত এক বাংলাদেশি বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের হৃদয়ে। আমাদের প্রচুর যোগ্যতা, ক্যাপাসিটি আছে। কিন্তু দেশে তার যথার্থ প্রয়োগ করার জন্যে, কাজে লাগানোর জন্যে তেমন ‘চ্যানেল’ নাই। হল্যান্ডের এনার্জি সেক্টরে কাজ করা এই বাংলাদেশি বলেন, ‘আমার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু বাংলাদেশের এনার্জি মিনিস্ট্রি আমার কথা কেন শুনবে?’ এই প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ’৮৬ সালে চীন গিয়েছিলাম। চীন ক্লোস্‌ড ইকোনমি। ফোন করার জন্যে বেগ পেতে হয়েছে। সেই চীন আজকে কোথায়। এর পেছনে চীন ডায়াসপোরাদের বিশাল ভূমিকা আছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চীনে আজকের যে উন্নয়ন তার পেছনে চীন প্রবাসীদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সে দেশের মোট এফ ডি আই-র শতকরা ৪০% ভাগের উপর বিনিয়োগ এসেছে চীন ডায়াসপোরাদের থেকে। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া চীনারা কেবল যে নিজ দেশে বিনিয়োগ করেছেন তা না, তারা তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, এডভান্সড প্রযুক্তি ও ম্যানেজারিয়েল জ্ঞান দিয়ে চীনের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। বিশ্ব অর্থনীতির সাথে চীনের যোগাযোগ ঘটাতে তারা সেতু হিসাবে কাজ করেছেন। অনেকেই মনে করেন, চীনের অর্থনীতি আজকের চাইতে ভিন্ন হতো, যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ৫ কোটি চীন-বংশোদ্ভূত নাগরিক না থাকতেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা এক কোটির উপর। কিন্তু সে অনুপাতে দেশে তাদের বিনিয়োগ নিতান্ত কম। নানা কারণে দেশে এই বিনিয়োগে প্রবাসীরা আগ্রহী হন না। যে সমস্ত কারণ তাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে তার মধ্যে অন্যতম হলো, ‘বিশ্বাস’। একজন প্রবাসী প্রবাসে তার কষ্টার্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করবেন, কিন্তু কার ভরসায়? সরকার? সেখানে ভরসা অনেকটা তলানিতে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, নিকটজন? তথৈবচঃ। তারপর রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি অফিসে এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসহযোগিতা, অসততা, মানুষকে অহেতুক ভোগান্তির শিকার করা যাদের স্বভাবগত চরিত্র এবং সর্বোপরি সঠিক তথ্যের অভাব, সেটি দুদিকেই- দেশে ও বিদেশে। এই সব নিয়ে আমরা যারা ডায়াসপোরা ‘ডায়াসপোরা ইনভেস্টমেন্ট’ নিয়ে প্রবাসে ও দেশে বিগত দিনে অনেক ‘চিল্লাচিল্লি’ করেছি, এখনো করে চলেছি। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়েছে বলে ঠাহর হয় না। তবে আমি আশাবাদী। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কথায় ‘আশার’ আভাস পাই, আশা না পেলেও। চীনের মত আমরাও একদিন বলতে পারবো কেবল ২০/২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স নয়, এর চাইতেও অনেক বেশি কিছু বাংলাদেশি ডায়াসপরারা দেশের জন্যে দিতে পারে। সে দিনের অপেক্ষায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি অস্বাভাবিক মৃত্যু আর তার চুলচেরা বিশ্লেষণ
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বসভায় প্রধানমন্ত্রীর তেজোদীপ্ত ভাষণ